রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
নির্বাহী কমিটির সভায় খালেদা

বিএনপির সঙ্গে পুলিশ প্রশাসন আছে

► ভোটে যেতে ছয় শর্ত
► যেখানে থাকি আপনাদের সঙ্গেই আছি
► বেইমানি করলে ছাড় নেই
► হঠকারিতায় যাবেন না

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির সঙ্গে পুলিশ প্রশাসন আছে

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনগণ নেই। বিএনপির সঙ্গে পুলিশ, প্রশাসন ও সশস্ত্রবাহিনী আছে। এ দেশের জনগণ আছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় লা মেরিডিয়ান হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পর ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এরপর গতকাল প্রথম দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠক করলেন খালেদা জিয়া। সোয়া এক ঘণ্টার বক্তৃতায় বিএনপি চেয়ারপারসন দেশের দ্রব্যমূল্য, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা, বিচার বিভাগসহ দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলেন। অনুষ্ঠানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.), মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চেয়ারপারসনের সঙ্গে মূল মঞ্চে বসেন। সভায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছাড়াও জাতীয় নির্বাহী কমিটিসহ বিভিন্ন স্তরের পাঁচ শতাধিক নেতা অংশ নেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী ও সহপ্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম।

৮ ফেব্রুয়ারি ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলার ঘোষণা হতে যাওয়া রায়ের দিকে ইঙ্গিত করে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘যেখানেই থাকি না কেন, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি, সঙ্গে থাকব। দেশের মানুষের সঙ্গে থাকব।’ তিনি বলেন, ‘যে কোনো বিপদ এলে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করুন। তবে এবার বেইমানি করলে কাউকে ক্ষমা করা হবে না। অতীতে একবার ক্ষমা করেছি, বার বার নয়।’

‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি’ দেওয়ার আভাস দিয়ে সবাইকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ বাঁচাতে এখন সবচেয়ে বেশি দরকার জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য।’ দুর্নীতির মামলার বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অপরাধই যেখানে নেই, সেখানে বিচারটা হবে কী?’ তিনি দেশের বিচার বিভাগকে সবচেয়ে পরাধীন বলে মন্তব্য করেন এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ছয় শর্ত জুড়ে দেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা বলেছি জাতীয় নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। জনগণ যাতে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে। সে রকম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এই সংসদ রেখে কখনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। পৃথিবীর কোথাও একটি সংসদ বিদ্যমান রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের নজির নেই। ভোটের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। তারা মাঠে থাকলে জনগণ নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে ইভিএম-টিভিএম চলবে না। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে।’

বেলা ১১টা ৮ মিনিটে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা শুরু হয়। এতে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন যুগ্মমহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। এরপর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর প্রতিবেদন পাঠ করেন। নির্বাহী কমিটির সভা চলার সময় হোটেলের সামনের রাস্তা থেকে ২০ জন কর্মীকে পুলিশ আটক করে বলে বিএনপি দাবি করেছে।

খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পর দুপুর দেড়টায় সভার প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। সভায় লন্ডন থেকে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ১৬ মিনিটের বক্তব্য ও আলোকচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এতে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আইনের শাসন ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন।

দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘এবার যারা বেইমানি করবে, যারা এক পা এদিকে অন্য পা আরেক দিকে রাখবে তাদের চিহ্নিত করা হবে। তাদের মূল্যায়নের জায়গা থাকবে না। এদের তারাও (ক্ষমতাসীন দল) নেবে না, আমরাও নেব না।’ তিনি বলেন, ‘যারা অতীতে আন্দোলন করেছে, দলের জন্য কাজ করেছে, দলের সঙ্গে বেইমানি করেনি, তাদের ভবিষ্যতে ভালো জায়গা দেওয়া হবে। যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে তাদের মূল্যায়ন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘এখনকার পুলিশ চায় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকুক, মৌলিক ও মানবাধিকার ঠিক থাকুক। তারা এ দেশের জনগণকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু পুলিশকে এমনভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। পুলিশকে বাধ্য করে দলীয় কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির কোনো ভয় নেই। বিএনপির সঙ্গে জনগণ আছে, পুলিশ আছে, সশস্ত্র বাহিনী আছে, প্রশাসন আছে, সাধারণ মানুষ আছে। দেশের বাইরে যেসব বাংলাদেশি তারাও আছে। ভয়টা এখন আওয়ামী লীগের। তাই কীভাবে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যায়, সেটাই তাদের বড় মাথাব্যথা।’ এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সাড়ে ১৮ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার মামলা দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। নিজের দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থানের কথা ব্যক্ত করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমাকে কেউ ভয়ভীতি, লোভ দেখিয়ে কিছু করতে পারবে না। অতীতেও পারেনি, এখনো পারবে না। আমি দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আছি, আমি দেশের মানুষের সঙ্গে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রচার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন। কেন এত আগে প্রচারণা? নৌকা এতটাই ডুবেছে যে তাকে (শেখ হাসিনা) আগেভাগেই প্রচারণা করতে হচ্ছে। জোর করে জনগণকে হাত তুলে ওয়াদা করিয়ে ভোট পাওয়া যায় না।’ প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি বন্ধ করে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন।’ মন্ত্রী-এমপিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের অনেকেই আত্মীয়-পরিজন বিভিন্ন দেশে রেখেছেন। তাদের হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু আপনাদের অনেকেই হয়তো তখন পালাবারও সময় পাবেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা (সরকার) মনে করছে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে প্রশাসন তাদের সহায়তা করবে। কিন্তু নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য প্রশাসন যদি একটু সহযোগিতা পায়, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, এই প্রশাসনে যারা আছেন, তারা কেউ তখন তাদের কথা শুনবেন না। কারণ তারা গণতন্ত্র চান, গণতন্ত্র থাকলে প্রশাসনে তাদের মূল্যায়ন হবে। তারা যে দলেরই হোন না কেন, বিএনপি সরকারে গেলে তাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করা হবে।’

নিজের মামলা প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিচারটা কোথায়? কিসের বিচার করবে? অপরাধই তো নেই! তার পরও তারা গায়ের জোরে বিচার করতে চায়। গায়ের জোরে কথা বলতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘আজকের যে পিপি, তাকে আমরা মইন উদ্দিনের (১/১১-এর সরকার) সময়ও দেখেছি। তিনি আইনজীবী, তাকে আমরা দোষ দেব না। তাকে বাধ্য করা হয় গলার স্বর উঁচু করে কথা বলতে।’ তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ আজ পুরোপুরি সরকারের কব্জায়। সঠিক রায় দিলে যে কী হবে তা সবাই জানেন। তারেক রহমানের রায়ের পর বিচারক দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।’ ওয়ান-ইলেভেনের সময় মামলা প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সেই সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোা ক্ষমতায় এসে তারা তুলে নেয়। আমাদের বিরুদ্ধে নতুন করে আরও মামলা দেওয়া হয়।’ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বেগম জিয়া বলেন, ‘তাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর, মন্দির ভাঙচুর করা হচ্ছে। তাদের সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে। এমনকি শ্মশানের জায়গা পর্যন্ত দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করা হচ্ছে। আসলে তারা কোনো ধর্ম-কর্মে বিশ্বাস করে না। মুসলমানদের বলে জঙ্গি আর হিন্দুদের ওপর নানাভাবে ভয়ভীতি দেখায়। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এখন বলছেন, তারা অনেক ভুল করেছেন, সুযোগ পেলে বিএনপির কাছে যাবেন।’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া একে কালাকানুন বলে মন্তব্য করেন। প্রশ্নফাঁসের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী কিছুই করতে পারছেন না। তিনি সহজসরল মানুষ। তিনি সত্যি কথা বলে ফেলেছেন। তিনি সহনীয় পর্যায়ে ঘুষ খেতে বলেছেন। তিনি সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন, “আমি (শিক্ষামন্ত্রী) চোর, মন্ত্রী-এমপিরাও চোর”।’

সর্বশেষ খবর