বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা

যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত

নিজস্ব প্রতিবেদক

যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত

‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় কেন্দ্র করে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি আছেন’ জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। আমাকে জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি মাথা নত করব না। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে পিছু হটব না। ন্যায়বিচার হলে আমি বেকসুর খালাস পাব।’

গতকাল বিকালে রাজধানীর গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর; স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.), ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী; ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক এমপি মেজর আখতারুজ্জামান (অব.) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমাকে রাজনীতির ময়দান ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখা এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আদালতকে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাতে ক্ষমতাসীনদের একদলীয় শাসন কায়েম এবং খালি মাঠে গোল দেওয়ার খায়েশ পূরণ হবে বলে আমি মনে করি না। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান একসময় মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে এ দেশের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের “এবেডা” অর্থাৎ নির্বাচন ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী— সেই “এবেডা” টেকেনি। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতন ঘটেছিল।’

তিনি বলেন, ‘ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের অবৈধ সরকার রাজনীতিবিদদের হেয় করা এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে আমাকে বিদেশে চলে যেতে বলেছিল। আমি তাদের কথায় রাজি না হয়ে আপনাদের ছেড়ে, দেশ ছেড়ে যাইনি। যার জন্য আমার ও আমার সন্তানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। আমাকে এক বছর নয় দিন কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। আমার দুই সন্তানকেও কারারুদ্ধ করে নির্যাতন করেছিল। সেই অবৈধ সরকার আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল।’ এ সময় পরিবারের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, ‘এর আগে কারাবন্দী থাকার সময় মাকে হারিয়েছি। পরেরবার বন্দী থাকার সময় এক সন্তানকে হারিয়েছি। আরেক সন্তান পঙ্গু অবস্থায় বিদেশে চিকিত্সাধীন।’

সংবাদ সম্মেলনে ‘দেশে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি চলছে’ উল্লেখ করে এ অবস্থায় জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা প্রসঙ্গে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে কোনোভাবেই আমি জড়িত নই। এর কোনো টাকাও সরকারি নয়। এক টাকাও তছরুপ হয়নি। বরং সুদে আসলে সেই টাকা তিন গুণ হয়েছে। কাজেই ন্যায়বিচার হলে আমার কিছুই হবে না। বেকসুর খালাস পাব। বরং যারা মামলা করেছে তাদের বিচার হওয়া উচিত। আর শাসক মহলকে তুষ্ট করার জন্য রায় হলে ন্যায়বিচার পাব না।’ জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক ফাঁদ পাতা হবে। ষড়যন্ত্র হবে। সবাই সতর্ক থাকবেন। বুঝেশুনে কাজ করবেন।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি তিনি বলেন, ‘জনগণের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেবেন না।’ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘এখনো আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে। আশা করি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশ এখন বৃহত্তর কারাগার। জনগণের শাসন কায়েম করে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তাই আসুন আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করি। আমাদের বয়স হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর দেশ গড়ে যাই।’ সংবাদ সম্মেলনে আবেগাপ্লুত বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমি কম বয়সেই স্বামী হারিয়েছি। দেশের জন্য জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন। দলের নেতা-কর্মীদের দাবিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির বিপত্সংকুল পথে পা বাড়িয়েছি। আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তির জীবন বিসর্জন দিয়েছি। রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখার পর থেকে আমি জনগণকে যতটা সময় দিয়েছি, পরিবার ও সন্তানদের ততটা দিতে পারিনি। আমার প্রিয় দেশবাসী আমাকে তার প্রতিদান দিয়েছেন অপরিমেয় ভালোবাসায়। প্রতিবারের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে পর্যন্ত তারা আমাকে নির্বাচিত করেছেন। কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আজ পর্যন্ত আমি পরাজিত হইনি। জনগণের সমর্থনে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব আমি অর্জন করেছি। তিনবার তারা আমাকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এখনো আমি দেশের যে প্রান্তেই যাই, উচ্ছ্বসিত জনজোয়ারে তাদের ভালোবাসায় অভিষিক্ত হই। আমি রাষ্ট্র পরিচালনায় কিংবা বিরোধী দলে যেখানেই থাকি এই জনগণ প্রতিটি সুখে-দুঃখে, শান্তিতে-সংগ্রামে আমার সাথী হন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের লাখো কর্মী আজ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অপহরণ, গুম, খুনের এক ভয়াবহ বিভীষিকায় বাংলাদেশ আজ ছেয়ে গেছে। ঘরে ঘরে আজ হাহাকার। স্বজন হারানো কান্নার রোলে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। হেনস্তা ও অপমানের ভয়ে নাগরিক সমাজ স্বাধীন মত প্রকাশের সাহস হারিয়ে ফেলেছে। এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও একদল উচ্ছিষ্টভোগী স্তাবকের গুণকীর্তনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। দলীয়করণ, ভীতি প্রদর্শন ও নানা অপকৌশলের মাধ্যমে দেশের বিচারব্যবস্থাকে আজ প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি অবশ্যই তাতে অংশ নিত। তাহলে বিএনপিই জনগণের সমর্থনে এখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকত। যাদের আজ ক্ষমতায় থাকার কথা সেই দলের সঙ্গে বিনা ভোটের সরকার এমন আচরণ করছে যেন বিএনপি নির্মূল করাই তাদের প্রধান কাজ। অফিসের ভিতরে আমাদের মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়েছে। সেই সময়ে বাইরের নানা ঘটনার জন্য আমাকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। আমার দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে জেলগুলো ভরে ফেলা হয়েছে। হাজার হাজার মামলা হয়েছে। যারা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ খুনের নির্দেশ দেয়, গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে বাসযাত্রী পুড়িয়ে মারে, যারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের নামে ব্যাংকে আগুন, পেট্রলপাম্প আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, রেললাইন তুলে দিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করেছে, দেশজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে তারাই আজ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করছে।’ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসে বিশ্বাস করি না। সারা দেশে প্রকাশ্য সন্ত্রাস করছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। তাদের কোনো বিচার হয় না। দেশের সব প্রথা-প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। কথা বলার অধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই, মানুষের ভোটের অধিকার নেই। ১০ টাকা দরে চাল খাওয়ানোর ওয়াদাকে ভয়াবহ ভাঁওতাবাজি হিসেবে প্রমাণ করে মোটা চালের কেজি এখন ৫০ টাকা করেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। দেশে ন্যায়বিচার নেই। ইনসাফ নেই। জনগণের কোনো নিরাপত্তা নেই। নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার। মানুষের কাজের সংস্থান নেই। চাকরির খোঁজে লুকিয়ে বিদেশে যাওয়ার পথে আমাদের তরুণরা সাগরে ডুবে মরছে।’

খালেদা জিয়া আরও বলেন, ‘কেবল নিজেদের দলীয় স্বার্থে ও সুবিধার্থে সংবিধান বদল করে গায়ের জোরে যারা এখন ক্ষমতায় টিকে আছে তারা জনগণের ভোটে আসেনি। দেশের মানুষ তাদের নির্বাচিত করেনি। তাদের দেশ পরিচালনার প্রতি জনগণের সায় ও সম্মতি নেই। নৈতিক দিক থেকে এরা অবৈধ। তাই তারা যতই হুঙ্কার দিক, তাদের কোনো নৈতিক সাহস ও মনোবল নেই। এই শাসকদের কোনো গণভিত্তি নেই। পেশিশক্তি, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে জনগণের বিরুদ্ধে অপব্যবহার করে ওরা টিকে আছে। জনগণের সমর্থন নেই বলেই তারা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ভয় পায়। আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই। জনগণের অধিকার তাদের ফেরত দিতে চাই। তাই আমরা আন্দোলন করছি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। যে নির্বাচনে মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারবে এবং সেই ভোট সঠিকভাবে গণনা করে সুষ্ঠুভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হবে। সব দল অংশগ্রহণ করতে পারবে। তেমন সুষ্ঠু নির্বাচন ক্ষমতাসীন দল চায় না। তাদের কথা, ক্ষমতায় থেকে এবং সংসদ বহাল রেখেই তারা নির্বাচন করবে। যাতে মানুষ ভোট দিতে না পারে এবং কারচুপির মাধ্যমে ফল পাল্টে দেওয়া যায়। এই প্রহসন তারা একবার করেছে। আবারও করতে চায়। সেই উদ্দেশ্যেই তারা আমাদের নির্যাতন ও হামলা-মামলা ও বন্দী করে তটস্থ রেখে সরকারি খরচে এক বছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রহসন নয়, সত্যিকারের নির্বাচন চায়। তেমন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছি বলেই আজ আমাদের ওপর এত জুলুম-নির্যাতন, এত মিথ্যা মামলা।’ দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমাকে আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হলেও বিশ্বাস করবেন, আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি। আপনারা গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, জনগণের সরকার কায়েমের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। বাংলাদেশে সবসময়ই ছাত্র-যুবক-তরুণরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সৈনিক-ছাত্র-জনতার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। এই ছাত্র-জনতার আন্দোলনেই স্বৈরাচার পরাজিত হয়েছে। আজ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সেই ছাত্র-জনতাকে আহ্বান জানাই এগিয়ে আসতে। বিএনপি, ২০ দলসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক দল, কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে আমি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগেও এমন অনেকে আছেন যারা গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারে বিশ্বাস করেন এবং ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভাবেন। তাদের প্রতিও আমার একই আহ্বান রইল।’

সর্বশেষ খবর