বৃহস্পতিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাজাপ্রাপ্তদের দল ও সরকারে পদ দেওয়া উচিত নয়

বিশেষজ্ঞদের মত

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলের কোনো পদে কিংবা সরকারের কোনো দায়িত্বে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। তাতে গণতন্ত্রের শুদ্ধতা, সুষ্ঠু নির্বাচন ও আইনের শাসন ব্যাহত হয়। রাজনীতিতে বিত্তশালী ও পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়।

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে আরও বলেন, আদালতে দোষী সাব্যস্ত কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক দল বা সরকারের কোনো পদে থাকা রাজনৈতিক, নৈতিক বা আইনগত—সবভাবেই অনুচিত। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, দণ্ডিত ব্যক্তিরা দায়িত্বশীল পদে থাকলে তারা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণ হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখার বলেন, কোনো দেশের রাজনৈতিক দল ও সরকারে বিতর্কিত ব্যক্তিদের দায়িত্বে থাকা আইনের শাসনের দুর্বলতারই প্রকাশ করে। উন্নত কোনো দেশে দণ্ডিত ব্যক্তির রাজনৈতিক পদে থাকার কথা ভাবাও যায় না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সর্বোচ্চ আদালত এ ধরনের সুযোগ নিষিদ্ধ করেছে। দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হওয়ার পর বাংলাদেশেও এ প্রশ্নটি উঠছে যে, অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর একজন নেতা বা নেত্রীর দলের নেতৃত্বে থাকা উচিত, কি উচিত নয়। গত বৃহস্পতিবার এই রায় দেওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া যদিও কারাভোগ করছেন, তিনি একই সঙ্গে দলীয়প্রধানের পদটি ধরে রেখেছেন। তার ছেলে তারেক রহমান একই মামলায় ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং তাকে অস্থায়ীভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপাসন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দল গঠন করতে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র তিন বিচারপতি নিয়ে গঠিত একটি বেঞ্চের প্রধান হিসেবে বলেন, ‘দোষী প্রমাণিত একজন ব্যক্তি কীভাবে একটি রাজনৈতিক দলের পদে থাকেন এবং নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেন? আমাদেরই জাজমেন্ট রয়েছে যে- নির্বাচনের শুদ্ধতার জন্য রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে।’

ভারতের বর্তমান আইনে দুই বছরের বেশি কারাদণ্ড হলে, সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে ছয় বছর ভোটে লড়া যায় না। তবে বিচার চলার সময়ে অপরাধীদের নির্বাচনে দাঁড়াতে কোনো বাধা নেই। এমনকি দুই বছরের বেশি জেল হলেও কোনো অপরাধীর রাজনৈতিক দল গড়া বা তার পদাধিকারী হওয়ায় কোনো আইনি বাধা বর্তমানে নেই। এই পরিস্থিতির বদল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি আবেদন করেন আইনজীবী অশ্বিনীকুমার উপাধ্যায়। জনস্বার্থে দায়ের করা এ মামলায় গত সোমবার সুপ্রিম কোর্ট ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করেন, ‘একজন যদি নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারেন, তাহলে তিনি কীভাবে রাজনৈতিক দল গঠন করবেন এবং প্রার্থী বাছাই করবেন?’ প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘এমনটি করতে দেওয়া মানেই হচ্ছে আপনি একা একটা কাজ করতে পারছেন না, কিন্তু ঠিকই অন্য প্রতিনিধিদের নিয়ে যৌথভাবে তা করিয়ে নিচ্ছেন।’

এদিকে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়ে সংবিধানের ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ফৌজদারি অপরাধ বা নৈতিক স্খলনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে পাঁচ বছর দণ্ড শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না।

এর আলোকে বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটির মর্মকথা হচ্ছে, দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের সরকারে ঢোকায় বাধা দেওয়ার কাজটি করতে হবে একেবারে গোড়াতে। তবে বাংলাদেশে অনেক ব্যক্তিই আদালতে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পরও দল বা সরকারে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ২১ জুলাই অর্থ পাচার মামলায় হাই কোর্ট তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। ঢাকার নিম্ন আদালত ২০১৩ সালে এই মামলায় তারেক রহমানকে খালাস দিয়েছিল।

২০১৪ সালে বিশেষ আদালত সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরকে ২০০৪ সালের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরবর্তী সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির রায় দেওয়া হলে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এইচ এম এরশাদ একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, কিন্তু তিনি দলের পদসহ অন্যান্য দায়িত্বে বহাল রয়েছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং আওয়ামী লীগ এমপি আবদুর রহমান বদি দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হওয়ার পরও নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অবশ্য মায়া পরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন।

আদালতের দেওয়া সাজা পুরোপুরি ভোগ না করেই আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম উদ্দিন হাজারী গত সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং এমপি নির্বাচিত হন।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। বিএনপির সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়েও রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং তিনি এর প্রধান হন। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতার হন অবৈধভাবে অ্যালকোহল রাখার দায়ে। এ সংক্রান্ত মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পরে খারিজ করে দেয় ২০০৮ সালে। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও মওদুদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে আছেন। এ ছাড়া বিএনপির অন্যতম নেতা ও সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপের অভিযোগের মুখোমুখি হন। বিএনপির সাবেক এমপিদের অনেক নেতা দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বা আসামি হওয়ার পরও দলীয় পদে আসীন রয়েছেন এবং তাদের অনেকেই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘দণ্ডিত হওয়ার পর দলীয় পদসহ অন্যান্য দায়িত্ব ধরে রাখা আইন, নীতি ও রাজনৈতিক নীতিনৈতিকতার পরিপন্থী।’ তিনি আরও বলেন, বিএনপির মূল গঠনতন্ত্রে ছিল, কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি দলের সদস্য হতে পারবে না। দলে দুর্নীতিগ্রস্তদের স্থান করে দিতে পরে বিধিটি সংশোধন করে স্বার্থান্বেষী মহল।

সর্বশেষ খবর