মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী গণ্য : আদালত

আরাফাত মুন্না

আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী গণ্য : আদালত

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে রায় ঘোষণার ১২ দিন পর সত্যায়িত অনুলিপি (সার্টিফায়েড কপি) পেলেন আইনজীবীরা। গতকাল বিকালে দুর্নীতি দমন কমিশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের পেশকারের কাছ থেকে রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি বুঝে নিয়েছেন। রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর খালেদার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতে আপিল করে খালাস চাইবেন তারা। অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী জানান, আসামিপক্ষের আপিলে লড়বেন তারা। রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর গতকাল রাতে আপিলের গ্রাউন্ডস ঠিক করতে বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে সরকারি এতিম তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ মামলার ছয়জন আসামির প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। অর্থনৈতিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করে এবং এর খারাপ প্রভাব সমাজে প্রতিটি স্তরে সংক্রমিত হয় বলেও পর্যবেক্ষণে মন্তব্য করেন আদালত। ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। খালেদা জিয়ার পাশাপাশি তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ মামলার অন্য পাঁচ আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান। রায়ে খালেদা জিয়া ছাড়া অন্য আসামিদের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা জরিমানাও করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পরপরই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে খালেদা জিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগার ভবনে। সেই দিন থেকে এখনো কারাগারেই রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। রায়ের ৬২৭ পৃষ্ঠায় আদালত বলেছে, ‘মামলার নথি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, এ মামলার আসামিগণ কর্তৃক পরস্পর যোগসাজশে সরকারি এতিম তহবিলের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। পরিমাণের দিক থেকে উহার বর্তমান বাজারমূল্য অধিক না হলেও প্রকৃত ঘটনার সময় ওই টাকার বাজারমূল্য অনেক বেশি ছিল।’ পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, ‘আসামিগণের মধ্যে আসামি বেগম খালেদা জিয়া ওই সময় এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আসামি কাজী সলিমুল হক ওরফে কাজী কামাল সংসদ সদস্য ছিলেন, আসামি ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা হয়েছে... আসামি বেগম খালেদা জিয়াকে সরকারি এতিম তহবিলের ব্যাংক হিসাব খুলতে সহায়তা করা এবং পরবর্তীতে ওই হিসাব থেকে দুটি প্রাইভেট ট্রাস্টের অনুকূলে সরকারি অর্থের চেক বেআইনিভাবে প্রদান করায় বর্ণিত দুজন আসামিকে অপরাধ করতে সহায়তা করার শামিল।’ পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, ‘আসামি তারেক রহমান, মোমিনুর রহমান, শরফুদ্দিন আহমেদ কৌশল অবলম্বন করে সরকারি এতিম তহবিলের টাকা একে অপরের সহযোগিতায় আত্মসাৎ করতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। এর মাধ্যমে এ মামলার ছয়জন আসামির প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন বলে এ আদালত মনে করে। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। অর্থনৈতিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করে এবং উহার বাজে প্রভাব সমাজে প্রতিটি স্তরে সংক্রমিত হয়।’ রায়ে আদালত বলে, ‘আসামিগণের মধ্যে একজন ব্যতীত বাকি সবাই সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করে সরকারি এতিম তহবিলের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা আত্মসাৎ করেন। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার বিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ওই ধারায় সংঘটিত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন বা যে কোনো মেয়াদে কারাদণ্ড, যা ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং অর্থদণ্ড দণ্ডনীয় হওয়ার বিধান রয়েছে।’ আদালত বলেন, ‘প্রসিকিউশন পক্ষের উপস্থিত সাক্ষ্য-প্রমাণের দ্বারা আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় আসামি বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, মোমিনুর রহমান, কাজী সলিমুল হক কামাল, শরফুদ্দিন আহমেদ এবং ড. কামাল উদ্দিন উভয়ে সংশ্লিষ্ট ধারার অধীনে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।’ রায়ে আদালত বলে, ‘দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা যে কোনো মেয়াদে কারাদণ্ড, যার মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত হতে পারে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামিগণ একে অপরের সহযোগিতায় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন। সে কারণে তাদের সর্বোচ্চ সাজার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। তবে আসামিদের বয়স, সামাজিক অবস্থান এবং আত্মসাত্কৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনা করে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা সমীচীন হবে না মর্মে আদালত মনে করে। তাই আসামি তারেক রহমান, কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, কাজী সালিমুল হক, শরফুদ্দিন আহমেদ ও মোমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারার বিধান মোতাবেক ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং বর্ণিত সকল আসামিকে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।’ আদালত বলে, ‘উক্ত অর্থদণ্ডের টাকা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক প্রত্যেককে সম অঙ্কে প্রদান করতে হবে। আরোপিত অর্থদণ্ডের টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত বলে গণ্য হবে। আগামী ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে তাদের প্রত্যেককে উক্ত টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে আদায় করার নির্দেশ দেওয়া গেল।’ আদেশে আদালত বলে, ‘বর্ণিত আসামিদের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। এ ছাড়া তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান কর্ণধার। তিনি একজন বয়স্ক মহিলা। তার সার্বিক অবস্থা বয়স এবং সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং ১০৯ ধারায় পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হলো।’

আজই আপিল হতে পারে : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আজই আপিল হতে পারে। এ জন্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা গতকাল রাতে বৈঠক করেছেন। রাত ৯টা থেকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলীর ধানমন্ডির চেম্বারে ওই বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপির সিনিয়র আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। তারা রায় নিয়ে পর্যালোচনা করেন। রাত সোয়া ১২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সিনিয়র আইনজীবীরা বৈঠক করছেন। কী কী গ্রাউন্ডে আপিল করা হবে এ বৈঠকে তারা সেই সিদ্ধান্ত নেবেন। আজ না আগামী বৃহস্পতিবার আপিল আবেদন করা হবে বৈঠক থেকেই সেই সিদ্ধান্ত আসবে। তবে আজই আপিল ও জামিন আবেদনের চেষ্টা করা হবে বলেও জানান ব্যারিস্টার এহসান।  বৈঠকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা রায়ের কপি পেয়েছি। এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে।’ অন্যদিকে উচ্চ আদালতের দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আপিল করলে সেখানে দুদকও লড়বে।’

সর্বশেষ খবর