বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে নতুন মর্যাদায় বাংলা

জুলকার নাইন

চীনের গুয়াংজুতে হাইটেক পণ্য তৈরির ব্যবসা করেন ঝিয়াং ঝু। বিশ্বের নানা প্রান্তের ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে সর্বশেষ প্রযুক্তির পণ্য তৈরি করে দেওয়াই তার ব্যবসা। জাতিগতভাবেই চীনা ভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষাতেই পারদর্শী নন ঝিয়াং ঝু। নানা দেশের নানা ভাষার ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করলেও ইংরেজি শিখতে চাননি ঝিয়াং ঝু। কিন্তু হঠাৎ করেই মজেছেন বাংলার প্রেমে। গুয়াংজুতে নিজ বাড়িতে টানা তিন মাস একজন বাংলাদেশি শিক্ষকের কাছে বাংলা ভাষা শিখেছেন তিনি। এখন দুই মাসের জন্য চলে এসেছেন বাংলাদেশে। উদ্দেশ্য, প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স করার পাশাপাশি রাস্তাঘাটে ঘুরবেন এবং বাংলা ভাষার চর্চা করবেন। গতকাল ঢাকার একটি হোটেলে বসে ঝিয়াং ঝু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুধু ব্যবসা করার জন্য বাংলা শিখছি এটা বললে আমার নিজের প্রতি অবিচার করা হবে। কারণ আমার মিলিয়ন ডলারের ব্যবসার বেশির ভাগই ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের সঙ্গে ব্যবসাটাও টাকার অঙ্কে বাংলাদেশের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেশি। এর পরও সেসব ভাষা শিখে বাংলা শেখাটা শুধু এই ভাষার সুরমাধুর্যের জন্য। তার ভাষায়, ‘আমি বাংলার প্রেমে পড়েছি।’ শুধু ঝিয়াং ঝু নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে প্রতিবছর অসংখ্য বিদেশি শিক্ষার্থী বাংলা ভাষার ওপর বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। জাপান, চীন, কোরিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, থাইল্যান্ড, নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশের শিক্ষার্থীরা বাংলা শিখছেন। এদের কেউ কেউ কর্মজীবনের প্রয়োজনে আবার কেউ কেউ শুধু ভালোবাসার টানে বাংলা ভাষা শিখছেন। এর বাইরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘লার্ন বাংলা’ থেকে গত সাত বছরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, এল সালভাদর, থাইল্যান্ড, পূর্ব তিমুর, নাইজেরিয়া, ব্রুনাইসহ ৪৫টি দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা প্রায় এক হাজার ভিনদেশি নাগরিক বাংলা ভাষা শিখেছেন। শুধু বাংলা শেখার জন্য বাংলাদেশের ভিসা সংগ্রহ করেছেন এমন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে।

গবেষকরা বলছেন, মূলত বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বাংলা ভাষার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ তৈরির সোপান হিসেবে কাজ করছেন। তাদের মতে, মূলত ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি লাভ করেছে বেশি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত-গবেষকদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছে। ফলে বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ সবচেয়ে পুরনো। এ ছাড়া শিকাগো, ইন্ডিয়ানা, মেলবোর্ন, হাইডেলবার্গ, প্যারিস, টরন্টো, অটোয়া, এডিনবার্গ, সরবোর্ন, মস্কো, প্যাট্রিস লুলুম্বা, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। পিকিং, প্রাগ, ওয়ারশ, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ কার্যক্রম শুরু করেছে।

বাংলা এখন বিশ্বের বিভিন্ন ছোট-বড় শহরের প্রধান ভাষা : সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এ দেশের মানুষের চাকরি বা কাজ-কারবারের খোঁজে সাহস করে অচেনা-অজানা বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। তবে বাংলার মানুষ যে দেশেই গেছেন সে দেশের কোনো না কোনো স্থানকে একটা মিনি বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন লন্ডন শহরের বাংলাটাউন বলে খ্যাত ব্রিকলেন, ওল্ডহ্যাম, বার্মিংহাম, আমেরিকার নিউইয়র্ক, কানাডার টরন্টো, সৌদি আরবের জেদ্দা শহরের মুছনা, গুলিল, পবিত্র মক্কা-মদিনা, দুবাই, বাহরাইন, ওমান, কাতার, ইতালির রোম, স্পেনের মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, জার্মানির বার্লিন, গ্রিসের এথেন্স, জাপানের টোকিও, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, জোহানেসবার্গ, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এবং বড় বড় শহরের এক বা একাধিক এলাকায় বাঙালিপাড়া, বাঙালিবাজার বা বাঙালিদের মিলনক্ষেত্র গড়ে তুলতে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তারা। এসব স্থানে গেলে মনে হয়, ভিনদেশে যেন একচিলতে বাংলাদেশ। নিউইয়র্ক, সিডনি, লন্ডন, প্যারিসসহ বিভিন্ন শহরে এখন বেশ কয়েকটি বাংলা কাগজ বের হয়। বাংলা বইয়ের দোকানও আছে এসব শহরে।

নিউইয়র্কে আধা ডজন বাংলা কমিউনিটি টেলিভিশনও চালু হয়েছে। এই শহরগুলো ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ শহর, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ প্রবাসে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো সম্ভব শুধু বাংলায় কথা বলে। বাঙালি অধ্যুষিত এসব শহরের বিভিন্ন স্থানে বাংলায় সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে চারপাশে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের নামে এই দোকানপাটের নাম রাখা হয়েছে। তৈরি হয়েছে ভাষাশহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারও।

জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার ক্ষেত্রে প্রয়োজন বিশাল অর্থের সংস্থান : এক দশক ধরে বাংলাদেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার দাবি জোরালো হয়েছে। ইংরেজি, চাইনিজ মান্দারিন, রুশ, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও আরবির পর বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার উদ্যোগও শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানও বেশ পাকা। কিন্তু জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে যুক্ত হলে অন্য ভাষায় অনুবাদের সমুদয় অর্থ দিতে হবে বাংলাদেশকে। এ কারণে এ বিষয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে জাতিসংঘে মোট ছয়টি দাফতরিক ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, রুশ ও চাইনিজ ভাষা ১৯৪৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। একই বছর ২৪ জুন শুধু ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। অন্যদিকে রুশ ও স্প্যানিশ ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে স্থান পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২২ জানুয়ারি ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। চীনাদের মান্দারিন ভাষা নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭৪ সাল থেকে। সব শেষে আরবি ভাষা জাতিসংঘের ষষ্ঠ দাফতরিক ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৩ সালে আর নিরাপত্তা পরিষদের ভাষা হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে।

সর্বশেষ খবর