বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সর্বজনীন বাংলায় বাধা কোথায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া বাংলাদেশে ৬৬ বছরেও সর্বজনীনভাবে বাংলা ব্যবহার সম্ভব হয়নি। অথচ বাঙালী জাতির স্বাধীনতা অর্জনের মূলভিত্তি মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। কিন্তু ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাত, আইন, চিকিৎসা, উচ্চশিক্ষা কোথাও নেই বাংলার ব্যবহার। সাম্প্রতিক সময়ের ইংরেজি মিডিয়ার আগ্রাসন থামিয়ে দিচ্ছে বাংলা শেখার আগ্রহও। এর মধ্যে বিদেশি টেলিভিশনগুলোর প্রভাবে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন ভিন দেশি ভাষার চর্চা। গণমাধ্যমেও চলছে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দির মিশ্রণে এক অদ্ভুত ভাষা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশিদের উদাসীনতা ও অনিচ্ছার কারণেই বাংলা ভাষাকে এখনো সর্বজনীন করা যায়নি।

প্রবীণ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে, এখন ভাষার প্রশ্নে বাংলাদেশে বিরাজ করছে সার্বিক বিভ্রান্তি। তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলা ভাষা। বাংলা বানান ও রচনারীতি নিয়েও বিশৃঙ্খলা ও ভ্রান্ত ধারণা বিরাজমান আছে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করতে হলে, উচ্চশিক্ষায় গবেষণায় ও বিচার ব্যবস্থায় বাংলা চালু করতে হলে, বাংলা বানানের আরও সংস্কার করতে হবে। ইংরেজি বানান স্থিতি লাভ করেছে সংস্কারের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে। সাহিত্য সৃষ্টিতে ও গবেষণায় রচনারীতিকে মুখ্য মনে করে বিষয়বস্তুকে গৌণ মনে করা ভুল। বিষয়বস্তু, রচনারীতি সবই গুরুত্বপূর্ণ কোনোটারই গুরুত্ব কম নয়। বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর গবেষণা আমাদের স্বাভাবিক উন্নতির সহায়ক হয় না। আমাদের দেখা দরকার ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহের ভাষানীতি। এগুলোর মধ্যেও কিছু দেশ অনেক উন্নত। তলিয়ে দেখা দরকার, ইংরেজি এত উন্নত ভাষা হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা তাদের জাতীয় ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না। দেখা দরকার কীভাবে তারা তাদের দেশে ইংরেজির সমস্যার সমাধান করছে। তাদের অভিজ্ঞতা দেখলে আমাদের বুদ্ধি খেলতে পারে। আমরা কোনোটা অনুকরণ করব না, তবে অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা আমাদের উন্নতির পথ প্রশস্ত করব।

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতে, ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার পর নীতিনির্ধারকদের, বিশিষ্ট নাগরিকদের, রাজনীতিবিদদের ও সরকারের মনোযোগ চলে গেল বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করার দিকে এবং বেশি করে অবহেলিত হতে লাগল বাংলা ভাষা। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের (১৯৯১) পর বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে ইংরেজির প্রতি অন্ধ মোহ সৃষ্টি হয়েছে। স্যাট, টোফেল, আইএলটিএস ইত্যাদি পরীক্ষা বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের গ্রাস করে নিয়েছে। এ অবস্থায় ১৯৯১ সাল থেকে একটির পর একটি ‘নির্বাচিত’ অদূরদর্শী সরকার বাংলা ভাষার প্রতি মনোযোগ ত্যাগ করে ইংরেজির দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিও হয়ে পড়েছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসসমূহের অভিমুখী। ক্রমে রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার সব স্তরে বাংলা চালু করার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শাসক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব বাংলা ভাষার অনুকূল নয়। চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান বলেন, আজ গোটা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ নানাবিধ সংকট চলছে। এই সংকটের মধ্যেও বাংলা ভাষা দাপটের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। বাংলা ভাষাকে দেশের সব ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে ব্যবহারের জন্য সরকার এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, অর্থনীতির সঙ্গে বাংলা ভাষাকে যুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে স্বীকৃতি বাড়াতে হবে। বাংলা শিখলে যেন মানুষ চাকরি পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। ভাষার মূল্য না থাকলে তা টিকবে না। ব্যাংকগুলোতে বাংলার সমাদর নেই। ১০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ফরম তৈরি করা হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ইংরেজরা ক্ষমতায় যখন ছিল তখন ইংরেজি জানলে চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। তাহলে এখন বাঙালিরা ক্ষমতায় থাকলে বাংলা কেন অগ্রাধিকার পাবে না। ইংরেজদের থেকে বেশি ইংরেজি প্রীতি দেখালে তো বাংলার সর্বজনীন বিকাশ সম্ভব না।

সর্বশেষ খবর