বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছয় দশকেও হয়নি ভাষাসৈনিকের তালিকা

আহমেদ আল আমীন

ভাষা আন্দোলনের পর ছয় দশকেও ভাষাসৈনিকদের একটি তালিকা হয়নি। একটি রিটের পর তালিকা করতে উচ্চ আদালতের তরফ থেকেও নির্দেশ এসেছে আট বছর আগে, তবু তালিকা হয়নি আজও। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়েছে, তারা জাতীয়ভাবে সম্মান ও মূল্যায়ন পাচ্ছেন। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পরও ভাষাসৈনিকদের একটি তালিকা নেই। ফলে মুষ্টিমেয় ছাড়া অধিকাংশ ভাষাসৈনিকই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অপরিচিত থেকে যাচ্ছেন। সম্মান ও মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এভাবে বঞ্চনার শিকার হয়ে ইতিমধ্যে ভাষাসৈনিকদের কতজনই যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন তার হিসাব নেই। তাদের মৃত্যুতে হারিয়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের কত না স্মৃতি। এ অবস্থায় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখনই এই তালিকা করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে জীবিত ভাষাসৈনিকদের সবার মৃত্যুর পর ত্রুটি ও বিতর্কমুক্ত তালিকা প্রণয়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। হাই কোর্টে রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভাষা আন্দোলনে সারা দেশের অনেকেই জড়িত ছিলেন। কিন্তু তালিকা না হওয়ায় মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তিকেই আমরা চিনি, বাকিরা বিস্মৃত। এই তালিকা করা হলে ভাষাসৈনিকদের সম্পর্কে জানা যাবে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা আছে, ভাষাসৈনিকদের তালিকাও থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, জীবিত ভাষাসৈনিকদের অনেকের কাছেই প্রাথমিক তালিকা আছে। তাদের সহায়তায় সরকারিভাবে একটি স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য তালিকা করা উচিত। কিন্তু তালিকার অভাবে ৯০ ভাগ ভাষাসৈনিক আজ বিস্মৃত। তাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া যাচ্ছে না। এটি দুঃখজনক। এ বিষয়ে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানাব। 

জানা গেছে, বাংলা ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির আন্দোলনে সারা দেশ থেকে জড়িতদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাই কোর্টে একটি রিট করা হয়। শুনানি করে ওই বছরের ২৫ আগস্ট বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এবং বিচারপতি নাঈমা হায়দারের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ রায় দেয়। রায়ে আদালত কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্ধারিত এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করা, যাতে সেখানে অসামাজিক কার্যক্রম না হয় এবং ভবঘুরে ব্যক্তিরা ঘোরাফেরা করতে না পারে। শহীদ মিনারের মূল বেদিতে মিটিং-মিছিল করা যাবে না। ভাষাসৈনিকদের জাতীয় পদক প্রদান করা। সরকারের কাছে আবেদন করলে সরকারি খরচে ভাষাসৈনিকদের চিকিৎসা প্রদান। ভাষাসৈনিকদের তালিকা তৈরি করা। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষার্থে জাদুঘর তৈরি। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ভাষাসৈনিকদের আমন্ত্রণ জানানো। স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা। কিন্তু হাই কোর্টের এই রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্ধারিত এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করা, শহীদ মিনারের মূল বেদিতে মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু ভাষাসৈনিকদের তালিকা হাই কোর্টের রায়ের আট বছরেও হয়নি।

এর ফলে হাই কোর্টের অন্য একটি নির্দেশনা অনুসারে ভাষাসৈনিকদের জাতীয় পদকও প্রদান করা যাচ্ছে না। আবার চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভাষাসৈনিকরা সরকারি সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রক্ষার্থে জাদুঘর তৈরির কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে শুরু হলেও পরে আর তা এগোয়নি। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ ভাষাসৈনিকই আমন্ত্রণ পান না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো শহীদ মিনার নেই। হাই কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১১ সালের ৫ মার্চ আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হলে শুনানি করে হাই কোর্ট রুল জারি করে। হাই কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ভাষাসৈনিকদের তালিকা না হওয়ায় সংস্কৃতি সচিবকে তলব করে আদালত। সচিব আদালতে ভাষাসৈনিকদের আংশিক তালিকা দিয়ে জানান, পরে তালিকা সম্পন্ন করা হবে। এরপর ভাষাসৈনিকদের তালিকা করতে একটি কমিটি করা হলেও সেই কমিটি তালিকা প্রণয়নে অস্বীকৃতি জানায়। এর প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আবার আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। এই আবেদনের পর শুনানি করে ছয় মাসের মধ্যে ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু এটি এখনো হয়নি।

সর্বশেষ খবর