বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু কেমন আছেন

বললেন ভাষা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে

ঝর্ণা মনি

ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু কেমন আছেন

’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা অমান্য করে প্রথম পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। ঢাকা           বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রওশন আরা বাচ্চু মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও পুলিশের টিয়ার শেল, লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে অংশ নেন। গত সোমবার পশ্চিম মিরপুরের বাসভবনে ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু ২১ ফেব্রুয়ারি বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে স্মৃতিচারণা করেন। সুদীর্ঘ সাড়ে ছয় দশক আগের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে রওশন আরা বাচ্চু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির রাত। শুনলাম পরদিন ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। বুঝতে পারছিলাম, আমাদের সংগ্রামী মনোভাবকে ভেঙে দেওয়ার জন্য এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্র। ছাত্রীদের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রবণতা ছিল বেশি। পরদিন (২১ ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্রীদের নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর। আমরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে এ দায়িত্ব পালন করি। আমি ও রোকেয়া খাতুন প্রথমে ইডেন কলেজ ও পরে বাংলাবাজার স্কুলে যাই। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এসে পৌঁছাই তখন বেলা ১১টা। প্রথমে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কিনা এ নিয়ে বিতণ্ডা চলে। শিক্ষার্থীদের এই বাকবিতণ্ডার মধ্যেই ট্রাকবোঝাই পুলিশে ক্যাম্পাস ভরে যায়।’ এই ভাষাসৈনিক জানান, ‘শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মোজাফফর আহমদ ও ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর মতিউর রহমানের মতো শিক্ষকরা পুলিশের রুদ্রমূর্তি দেখে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় আমাদের হলে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানান। শিক্ষার্থী অলি আহাদ ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে দৃঢ় থাকেন। কিন্তু আবুল হাশিম বলেন, এখনই ১৪৪ ধারা না ভেঙে প্রশাসনিকভাবে সমাধান করা হবে। এসব বিতর্কের কারণে আমি ও অন্য আন্দোলনকর্মী শাফিয়া খাতুন সভা বয়কট করে মেয়েদের কমনরুমে চলে যাই। আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ছিলাম। এরপর ছাত্রদের অনুরোধে আবার ফিরে এসে ছোট ছোট দলে মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দেয়। সভা থেকেই সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি দলে একটি মেয়ে থাকবে। কারণ, পুলিশ হয়তো মেয়েদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কোনো হঠকারী আচরণ করবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা প্রথমেই তাদের দল নিয়ে গেটের একেবারে কাছাকাছি চলে আসে।’

স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘পুলিশ গেটের ওপর লাঠির ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল। প্রথম দলের নেত্রী শাফিয়া খাতুন লাঠির ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে পার হয়ে গেলেন। দ্বিতীয় দলের নেত্রী হালিমা গেলেন নিচ দিয়ে। আমি ছিলাম তৃতীয় দলের দায়িত্বে। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিই, লাঠির ওপর বা নিচ দিয়ে না গিয়ে ব্যারিকেড ভাঙাবই। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। আমাদের ধাক্কায় ব্যারিকেড ভেঙে যায়। অন্য ছেলেদের সঙ্গে আমি আহত হই। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল ছোড়া। মুহূর্তেই রণাঙ্গনে পরিণত হয় পুরো এলাকা। মেডিকেলের মোড় পর্যন্ত পৌঁছাতেই শুরু হয়ে গেল গুলি। উপায় না দেখে মেডিকেলের মোড়ে ভাঙা রিকশার নিচে আশ্রয় নিলাম। পাশেই ছিল এসএম হলের প্রভোস্ট ড. ওসমান গনির বাড়ি। বাড়িটি কাঁটাতারে ঘেরা। ঠিক করলাম এই বেড়া পার হব। বেড়া পার হতে গিয়ে কাঁটাতারে আমার শাড়ি আটকে গেল। আমি ঝুলছিলাম ত্রিশঙ্কু অবস্থায়। অবিরাম গুলি চলছিল। এ অবস্থায় কে বা কারা আমার শাড়িটি ছাড়িয়ে দিয়েছিল পেছন থেকে বোঝার উপায় ছিল না। কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ড. গনির বাড়িতে গিয়ে দেখলাম ভিতরে সুফিয়া আহমদ, সারা তৈফুর, শামসুন সুরাইয়া হাকিম রয়েছেন। সেখানেই খবর আসে বরকত, সালাম, জব্বার শহীদ হয়েছেন। আরও শুনতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামের কাছে ওহিউর রহমান নামে ১২-১৪ বছরের একটি ছেলেও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। বিকালে হোস্টেলের সামনের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী একাকী বিষণ্ন মনে হেঁটে যাচ্ছেন। তিনিই আমাদের হোস্টেলে পৌঁছে দেন।’ শহীদের রক্ত মেখে আন্দোলন আরও বেগবান হয় উল্লেখ করে রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গায়েবানা জানাজা ও শোকমিছিল হয়। সালামের রক্তমাখা স্থানে দাঁড়িয়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কান্নায় সেদিন কাঁদছিল পুরো জাতি।

 সেদিন শেরেবাংলা ১০০ টাকার একটি নোট আমাদের আন্দোলনের জন্য তুলে দেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের আন্দোলনে শামিল হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল পালিত হয়।’ ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘আমার পরিবার ছিল মুসলিম রক্ষণশীল পরিবার। আমাদের বাড়ির পুকুরটা ছিল বাড়ির বাইরে। নয় বছর বয়সের পর থেকে আমাকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। আর মুসলমান সমাজও সে সময় এত অগ্রসর ছিল না। এ কারণে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাকে শিলংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’ এরপর পিরোজপুর ও বরিশালে পড়ালেখা করার পর ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। তখন অনার্স ক্লাসে তিনজন ছাত্র আর তিনজন ছাত্রী ছিলেন। তবে সাবসিডিয়ারি ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থী ছিলেন। রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘মেয়েদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াও কঠিন ব্যাপার ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল নয়, সব জায়গায়ই এ অবস্থা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম ঠিকই, তবে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। এমন কড়াকড়ি ছিল। কথা বললে ১০ টাকা জরিমানা। ক্লাস শুরুর আগে মেয়েদের কমনরুমে বসে থাকতে হতো। শিক্ষক ক্লাসে ডেকে নিয়ে যেতেন।

ক্লাসে মেয়েদের বসানো হতো প্রথম বেঞ্চে। ছেলেদের পেছনে। ক্লাস শেষে মেয়েদের আবার কমনরুমে পৌঁছে দিতেন শিক্ষক। তবে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির পর এই কালাকানুন আর টেকেনি।’ তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধু নুরুন্নাহার কবীর দ্রুত পোস্টার লিখতে পারতেন। আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় চাঁদা সংগ্রহ, পোস্টার লেখাসহ অন্য কাজগুলো আমরা করতাম। এসব করতে গিয়েও আমরা ছাত্রদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে পারিনি। তার পরও আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি বিভাগে ৬০-৭০ জনের বেশি ছাত্রী ছিল না। তাই দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে বুঝিয়ে আন্দোলনের জন্য ছাত্রী সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় তাদের নিয়ে আসতাম। কারণ আমরা ভাষার বিষয়ে একটা জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে চেয়েছি। জাতীয় ঐক্য না থাকলে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হতে পারে না।’

যে ভাষার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার, সেই ভাষাই আজ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে আক্ষেপ করে এই ভাষাকন্যা বলেন, ‘অশুদ্ধ উচ্চারণ, ভুল বানান, বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে এখন বাংলা বলা হচ্ছে। এতে ভাষা-সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই প্রজন্মের কাছে আমার চাওয়া, যে ভাষার জন্য সালাম-রফিক রক্ত দিয়েছেন, আমরা জীবন বাজি রেখেছি, সেই ভাষাকে তোমরা অন্তত শুদ্ধভাবে ব্যবহার কর। বিকৃত করে মধুর বাংলা ভাষা ধ্বংস করো না।’

সর্বশেষ খবর