বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পুলিশে জিরো টলারেন্স

ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সদর দফতর কনস্টেবল নিয়োগ তদারকিতে আইজির নেতৃত্বে কমিটি

সাখাওয়াত কাওসার

পুলিশে জিরো টলারেন্স

ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে যাচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। গত রবিবার পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ত্রৈমাসিক অপরাধ সভার বার্তা পৌঁছে গেছে পুলিশের সব ইউনিটে। সোমবার কুমিল্লার মুরাদনগরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদিউজ্জামানকে দুর্নীতির অভিযোগে তাত্ক্ষণিক প্রত্যাহার করা হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলবে। পুলিশের চলমান উপ-পরিদর্শক নিয়োগ ও আগামী মাসে শুরু হতে যাওয়া কনস্টেবল নিয়োগ তদারকি করবে পুলিশ মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে একটি বিশেষায়িত কমিটি। নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে দেশের সব কটি জেলায় একজন পুলিশ সুপার ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়া তদারকি করবেন।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, অপরাধ সভায় ঘুষ ও নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা বলেছেন, ঘুষ ও দুর্নীতির কারণেই মূলত দেশে মাদক ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। এই ঘুষের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক নেতাও জড়িত। তবে বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষা এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনতে নানা ধরনের উদ্যোগের সুপারিশ এসেছে অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে।

দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এলাকার অনেক ওসির দুর্নীতির বিষয়ে অবগত হয়েছিল পুলিশ সদর দফতর। তারা তদবির করিয়ে শাস্তিমূলক প্রক্রিয়া গ্রহণ বন্ধ রেখেছিল। এসব দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার অভিযোগের ফাইল নতুন করে উত্থাপন হবে বলে জানা গেছে। কুমিল্লার মেঘনাঘাট থানায় চলতি সপ্তাহে ৭ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা তদন্তে বিশেষ টিম গঠন করেছেন জেলার পুলিশ সুপার। লক্ষাধিক পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হলেও মাত্র ৭ হাজার জব্দ তালিকায় দেখানো হয়েছিল। ওই ঘটনায় সার্কেল এএসপির বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে। এ ব্যাপারে কুমিল্লার পুলিশ সুপার শাহ্্ আবিদ হোসেন বলেন, মুরাদনগরের ওসির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত ছিল এক মাস আগের। তবে তা এত দিন ঝুলে ছিল। প্রবাসী ছেলে খুনের বাদী মায়ের বিরুদ্ধে উল্টো মাদক মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তার উদাসীনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর মেঘনাঘাটের বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে।

একাধিক সূত্র আরও বলছে, পুলিশ সপ্তাহের পরপরই কনস্টেবল নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে তা স্থগিত করা হয়। আগামী মাসে নিয়োগ প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হচ্ছে। এবার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ঠেকাতে আইজিপির তত্ত্বাবধানে একজন পুলিশ সুপার ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার দুজনের টিম প্রতিটি জেলা সফর করবে এবং তত্ক্ষণাৎ পুলিশ সদর দফতরকে অবহিত করবে। স্থানীয় আতিথেয়তা গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে তাদের দুজনের জন্য খাওয়া-থাকা ও যাবতীয় খরচ পুলিশ সদর দফতর বহন করবে। অন্যদিকে, যারা পুলিশ সদর দফতরসহ বিভিন্ন ইউনিটে তিন বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের অন্যত্র বদলির বিষয়টি খতিয়ে দেখছে সদর দফতর। যদিও এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনার পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিষয়ে শিথিলতা দেখানো হবে বলে একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান বলেন, একটি মহল পুলিশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তারা টার্গেট করেই নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি তিন মাস পরপর বৈঠক হয়। বৈঠকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি পরবর্তী তিন মাসের সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। অপরাধ সভায় দেশের সব জেলার পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে মহানগর, রেঞ্জ ও অন্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন।

গত সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এবারের সভায় নানা আলোচ্য বিষয় থাকলেও মাদক নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা মাদক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, কাকের মাংস কাকে খায় না, কিন্তু পুলিশের মাংস যদি পুলিশ খায় তাহলে অপরাধ বন্ধ হবে কীভাবে? ওই কর্মকর্তা বলেন, কোনো কোনো থানায় নতুন ওসি যোগদান করতে হলে তাকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। শুধু ওসি নন, এসআই ও এএসআই বদলি করতেও লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এত টাকা ঘুষ দেওয়ার পর ওই কর্মকর্তা মাদকের সঙ্গে যুক্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। নইলে ঘুষের এই অর্থ তিনি তুলবেন কী করে? আবার জেলার প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা যদি ওসির কাছ থেকে টাকা নেন, তাহলে তাকে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে বলবেন কীভাবে? মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও ডিআইজিরাও টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিচ্ছেন। যে কারণে মাদকের সঙ্গে পুলিশের সংযোগ কমছে না, মাদক বন্ধও হচ্ছে না। সভায় আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায়ভার প্রতিষ্ঠান বহন করবে না। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। জুনিয়রদের কাছ থেকে সিনিয়ররা যদি লজ্জা পেতে না চান, তাহলে এখনই সংশোধন হোন। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, পুলিশের হাইকমান্ড একটু কঠোর হলেই নিয়োগ, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। দরকার সদিচ্ছা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর