শিরোনাম
শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফের আলোচনায় কাউয়া

একের পর এক প্রকাশ হচ্ছে পোস্টার, হৃষ্টপুষ্ট কাউয়া তাড়াতে ব্যস্ত তৃণমূল আওয়ামী লীগ

রফিকুল ইসলাম রনি

ফের আলোচনায় কাউয়া

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফের আলোচনায় এসেছে ‘কাউয়া’। রাজধানীসহ জেলা-উপজেলায় এত দিন দলের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ও ক্ষমতার ক্রিম খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট কাউয়া তাড়াতে ব্যস্ত তৃণমূল আওয়ামী লীগ। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে কাউয়ামুক্ত আওয়ামী লীগ চেয়ে বিলবোর্ড ও পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের ‘কাউয়া’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন তারা। গত বছর ২২ মার্চ সিলেটে বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় সংগঠনে ‘কাউয়া’ ঢুকছে বলে মন্তব্য করেছিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বছর শেষ না হতেই আবারও আলোচনায় এসেছে কাউয়া। তবে এবার কেউ মন্তব্য করেননি, যেসব জায়গায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটি গঠনের কাজ চলছে সেসব জায়গায় যেন উড়ে এসে জুড়ে বসাদের স্থান দেওয়া না হয় সেজন্য পোস্টার ও বিলবোর্ডের মাধ্যমে সোচ্চার হচ্ছেন দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা। জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা নিজ এলাকায় ভিত্তি মজবুত করতে জামায়াত নেতাদের ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামী লীগে বরণ করে নেন। কারও কারও বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগও উঠেছিল। গত ১০ বছরে শুধু জামায়াতই নয়, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতারা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে। তারা স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে মামলা থেকে বাঁচতে নৌকায় চড়েন। এরাই মূলত কাউয়া বা হাইব্রিড নামে পরিচিত। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘দাঁড় কাউয়ামুক্ত মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগ চাই’ লেখাসংবলিত একটি বিলবোর্ডের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর নতুন আলোচনায় আসে ‘কাউয়া’। ২১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে রাতের অন্ধকারে উপজেলা শহরের দোকানে, স্কুল-কলেজের দেয়ালের সামনে একটি পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টারে লেখা রয়েছে, ‘কাউয়ামুক্ত টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন চাই, কাউয়া করে কা কা দলের বাজে বারো টা’। লেখাটির ডান পাশেই বিশাল একটি দাঁড়কাকের ছবি। তৃণমূল আওয়ামী লীগের ব্যানারে রাতের অন্ধকারে কে বা কারা এই ব্যানার লাগাল তা নিয়ে শহরজুড়ে চলছে আলোচনা। পোস্টারগুলো জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরাই এমন ছবি লাগিয়েছেন।

ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা বলছেন, যাদের কাউয়া বোঝানো হয়, তাদের কোনো এলাকা নেই, কর্মী নেই। কোনো কর্মীর দায়িত্ব কিংবা খবর এরা রাখে না। তারা সবসময় সরকারি দলের লোক। ক্ষমতায়    আসার পর কিছু নেতার হাত ধরে সরকারি দলে ভিড়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। দুঃসময়ের কর্মীরা এদের দাপটে এমপি-মন্ত্রীদের পাশে ভিড়তে পারেন না। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি শ্রেণি আছে, যারা সবসময়ই সরকারি দলের লোক। সে কারণেই ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বাড়ে। আর এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আগামীতেও ক্ষমতায় আসার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে কাউয়া নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তৃণমূলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা। দলীয় সূত্রমতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কিছু এমপি-মন্ত্রী ও নেতা নিজ নিজ এলাকায় নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করছেন। নিজের দল ভারী করতে তারা বিএনপি-জামায়াতের হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামিকে দলে ভেড়াতে ‘কাউয়া’ বানিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসাচ্ছেন। সেই প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত। উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতারা এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করছেন না। বিগত সময়ে যারা বিএনপি-জামায়াতের হামলা-মামলাসহ নানা অত্যাচার সহ্য করেছেন তারা এখন যেন বিরোধী দলে। একদা যেসব ‘কাউয়া’র হাতে নির্যাতিত হয়েছেন তারাই এখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. হারুন-অর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এক দশক ধরে ক্ষমতায় আছে এবং খুব ভালো অবস্থানে আছে। অন্য যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে। চাওয়া-পাওয়ার জন্য যারা রাজনীতি করে তারা মনে করে যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এবং আগামীতেও আসার সম্ভাবনা রয়েছে, সে কারণে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া নিরাপদ। আর যদি তারা দেখত এই সরকারের আর বেশি দিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই, তাহলে তারা কেটে পড়ত।’ তিনি বলেন, ‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। কাজেই অনুপ্রবেশকারীরা দলের নীতিনির্ধারককে প্রভাবিত করবে এমন সুযোগ নেই। তবে ভিতরে থেকে অপকর্ম বা আওয়ামী লীগের আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ড করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। কেউ যদি আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে দলে ভেড়েন তাহলে তাকে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে তারা আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু আসার সঙ্গে সঙ্গে দলের পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে তাদের পদ-পদবি দিয়ে দেওয়া হলে সর্বনাশ ডেকে আনবে। দলের লক্ষ্য-আদর্শের পরিপন্থী হবে। যারা দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন তারা হতাশ ও আহত হবেন।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্ষমতার সঙ্গে কাউয়া ঢুকে যায়। আর কিছু কিছু নেতা দল ভারী করতে কাউয়াদের নাম লিস্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। কিছু এমপি-মন্ত্রী ও নেতা দল ভারী করতে বা বিশেষ সুবিধা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যা করেছেন এমন ব্যক্তিকেও দলে স্থান দিয়েছেন। এসব কাউয়া বা হাইব্রিড নেতা সময় বুঝে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করছেন। এসব হাইব্রিডের জন্য আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতা-কর্মীরা দলে কোণঠাসা। এখন বিভিন্ন ইউনিটিতে কমিটি গঠনের কাজ চলছে। এসব কমিটিতে যেন অনুপ্রবেশকারীর স্থান না হয় সেজন্য কাউয়ামুক্ত আওয়ামী লীগ চেয়ে বিলবোর্ড ও পোস্টার করেছে বলে মনে করছি।’ শুধু আওয়ামী লীগই নয়, কাউয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে ২০-দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যেও। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘দাঁড় কাউয়ামুক্ত মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগ চাই’ শিরোনামে একটি সংবাদ শেয়ার করে রাজনীতিবিদদের কাউয়া থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি লেখেন, ‘শুধু কাউয়া নয়, এখানে স্যুট পরা কাউয়া, পাঞ্জাবি পরা কাউয়াও আছে। এদের কোনো এলাকা নেই, কর্মী নেই। কোনো কর্মীর দায়িত্ব কিংবা খবর এরা রাখে না। কোনো কর্মীর বিপদে এরা দাঁড়ায় না, একটা টাকাও খরচ করে না। এরা জীবনে একটা মেম্বার নির্বাচনও করে নাই বা করার যোগ্যতাও নাই। এরা কেবল বিভিন্ন টকশোতে তত্ত্ব, দর্শন আর পরিসংখ্যান দিতে থাকে। এদের রাজনীতি অনেকখানি বই পড়ে সাইকেল চালানো শেখার মতোন। এরা ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়ায় আর সরকারি কিছু কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে খাতির রাখে। কীভাবে একটা মনোনয়ন পাওয়া যায় সেটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। এরা গণজাগরণের সময় সামনে থেকে গলা ফাটায় কিন্তু গণজাগরণ যখন ধাওয়া খায় তখন এরা পালায়। এরা হেফাজত ইসলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার কিন্তু সরকার যখন হেফাজতের সঙ্গে মিটিং করে এরা নিশ্চুপ। এরাই প্রকৃত হাইব্রিড... ডিজিটাল হাইব্রিড। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের এদের কাছ থেকে সাবধান থাকা উচিত।’ মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, দলে অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের দীর্ঘদিনের ঘোষণা ছিল। এবার মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও এ দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তারা ব্যানার-ফেস্টুন করে অনুপ্রবেশকারীদের দলে না নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। রাজধানীর ধানমন্ডির ২৭ সড়কের শঙ্কর আবাসিক এলাকার বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে ৩০ ফুটেরও বেশি দৈর্ঘ্যের বিলবোর্ডটি সাঁটানো হয়েছে। ‘দাঁড় কাউয়ামুক্ত মোহাম্মপুর থানা আওয়ামী লীগ চাই’ লেখাটির ডান পাশেই বিশাল একটি দাঁড়কাকের ছবি দেওয়া হয়েছে। এরপর ছবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা ভাইরাল হয়ে যায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর