রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পুলিশি বাধায় পণ্ড বিএনপির কর্মসূচি

ফখরুলসহ আহত শতাধিক। আলালসহ গ্রেফতার অর্ধশত। কাল সারা দেশে বিক্ষোভ

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশি বাধায় পণ্ড বিএনপির কর্মসূচি

নয়াপল্টনে গতকাল ফখরুলসহ নেতা-কর্মীদের ওপর পানি নিক্ষেপ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুলিশি অ্যাকশনে পণ্ড হয়ে গেছে বিএনপির কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে এ কর্মসূচি ডাকা হয়েছিল। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা ছিল। এজন্য সকাল থেকেই নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। ওই এলাকা থেকে পুলিশ কয়েক দফায় বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জলবায়ুবিষয়ক সহসম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, সাবেক এমপি রাশেদা বেগম হীরাসহ অন্তত অর্ধশত নেতা-কর্মী আটক করে। পুলিশি লাঠিচার্জ, গরম পানি নিক্ষেপসহ ধস্তাধস্তিতে আহত হন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালী, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়চৌধুরীসহ শতাধিক নেতা-কর্মী। গুরুতর আহত ১০ জনকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পুলিশ বলছে, বিনা অনুমতিতে বিএনপি নেতা-কর্মীরা সড়ক দখল করে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটানোয় তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালনের জন্য অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই। ঘরের ভিতরে সংবাদ সম্মেলন করলেও কি পুলিশের অনুমতি নিতে হবে— প্রশ্ন তোলেন বিএনপি মহাসচিব। একই সঙ্গে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ বিনা উসকানিতে হামলা চালিয়েছে। ইচ্ছা করেই তারা সংঘাতে জড়াতে চাইছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আগামীকাল ঢাকা মহানগরীর থানায় থানায় এবং ঢাকার বাইরে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।

সকাল ১০টার দিকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের স্রোত নামতে থাকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে। সোয়া ১০টার দিকে কার্যালয় থেকে নিচে নামেন রিজভী আহমেদ, সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, সহপ্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমসহ নেতা-কর্মীরা। এ সময় চারপাশ দিয়ে পুলিশ নেতা-কর্মীদের ঘিরে ফেলে। এর আগেই কার্যালয়ের সামনেই রাখা হয় রায়ট কার, জলকামান, প্রিজন ভ্যান, সাদা মাইক্রোবাস ও পুলিশের কয়েকটি গাড়ি। ক্রমেই জড়ো হতে থাকেন সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় পার্টি অফিসের সামনেই নেতা-কর্মীরা কালো পতাকা নিয়ে নানা স্লোগান দিতে থাকেন।

সকাল ১০টা ২০ মিনিটে কার্যালয়ের সামনে পুলিশ অতর্কিতে নেতা-কর্মীদের ওপর চড়াও হয়। এ সময় বিএনপি মহাসচিব গাড়ি থেকে নামেন। তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে এগিয়ে এলে তিন কর্মকর্তা তাকে ঘিরে নিয়ে যেতে থাকেন। এই সময়ে সাঁজোয়া যান হুইসেল বাজিয়ে কার্যালয়ের দিকে এগোতে থাকে। একপর্যায়ে তারা মির্জা ফখরুলকে কার্যালয়ের দিকে যেতে দেন। মির্জা ফখরুল ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুকসহ কয়েকজন নেতা কার্যালয়ের সামনে আসতেই জলকামান দিয়ে রঙিন পানি নিক্ষেপ করে। বিএনপি মহাসচিব হাত উঠিয়ে পুলিশকে এটা ছুড়তে বারণ করলে গরম রঙিন পানির নল মহাসচিবের দিকেই তাক করে।

মুহূর্তের মধ্যে সাদা স্টাইপ ফুল শার্ট পরিহিত মির্জা ফখরুল ভিজে যান। পানির তীব্র স্রোতে মহাসচিবকে রক্ষা করতে কয়েকজন নেতা-কর্মী সামনে এসে দাঁড়ালেও তিনি রক্ষা পাননি।

আটক আলাল-বাবুল : নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি থেকে দেড় শতাধিক নেতা-কর্মী পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে দাবির বিএনপির। তবে পুলিশ অর্ধশত নেতা-কর্মীকে আটক করেছে বলে নিশ্চিত করেছে। গ্রেফতার হওয়া নেতা-কর্মীর মধ্যে যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জলবায়ুবিষয়ক সহসম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক রাশেদা বেগম হীরাও রয়েছেন।

পুলিশি লাঠিপেটায় গুরুতর আহতদের মধ্যে রয়েছেন আতাউর রহমান ঢালী, ফজলুল হক মিলন, স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক নিলোফার চৌধুরী মণি, নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়চৌধুরী, শাহানা আক্তার শানু, সাবেরা আলাউদ্দিন, শেখ ওয়াহিদুজ্জামান দীপু, জাসাসের সহসভাপতি শাহিনুর ইসলাম শায়লা। এর মধ্যে নিপুণ রায়চৌধুরী ও শায়লার হাত ভেঙে গেছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিকালে সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতার হওয়াদের তালিকা তুলে ধরে বলেন, ‘দেড় শতাধিক নেতা-কর্মীকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছেন। পুলিশের নির্মম লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন ২৩০ জনের অধিক নেতা-কর্মী।

বেলা ১১টার দিকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান কার্যালয়ে ঢোকার সময় আরেক দফা অ্যাকশন চালায় পুলিশ। সাবেক ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলকে টেনেহিঁচড়ে পুলিশ-ভ্যানে তোলা হয়। একই সময়ে কেন্দ্রীয় নেতা হালিমা নেওয়াজ আরলিসহ কয়েকজন নারী নেত্রীকে আটক করা হয়।

এ সময় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ম্যুরালসংলগ্ন দেয়াল ভেঙে পড়ে। ভিতরে পানি আর জুতার স্তূপ জমে যায়। পর্যায়ক্রমে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান; ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, রুহুল আলম চৌধুরী; গোলাম আকবর খোন্দকার, খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, হারুনুর রশীদ, আমিরুল ইসলাম খান আলীমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা কার্যালয়ে প্রবেশের মুখে বাধা ও হয়রানির শিকার হন।

দুপুরে সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদের সঙ্গে কার্যালয় ত্যাগ করার সময় গ্রেফতার হন মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

সরকার দেশকে সংঘাতময় করছে : কয়েক দফা হামলার পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি বলেন, কালো পতাকা প্রদর্শনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে উসকানি দিয়ে সরকার নিজেই দেশকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিনা উসকানিতে অতর্কিতে হামলা করে। এই অবৈধ সরকারের মন্ত্রীরা সারাক্ষণ চেষ্টা করছেন উসকানি দিতে এবং এ ধরনের নির্যাতন-অত্যাচার চালিয়ে পুরো পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফেলছেন। পুরো পরিস্থিতি তারা নিজেরাই এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছেন যেন সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, বিএনপি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিশ্বাস করে। সেভাবেই কর্মসূচি চালিয়ে আসছে।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের এ কর্মসূচি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। রাস্তা বন্ধ না করে কালো পতাকা প্রদর্শনের ব্যবস্থা আমরা করেছিলাম। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ কর্মসূচিতে অতর্কিত হামলা করে। পুলিশ নেতা-কর্মীদের বেপরোয়া গ্রেফতার করে, টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। তারা লাঠিচার্জও করে। আমি পুলিশ সদস্যদের এহেন আচরণের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা এর কোনো জবাব না দিয়ে রঙিন পানি ছুড়তে থাকে। বেধড়ক লাঠিচার্জ ও গ্রেফতার অব্যাহত রাখে। এর কিছুক্ষণ পর আমাদের কার্যালয়ে টিয়ার গ্যাস ছুড়লে ভিতরে দম বন্ধ করা হিটলারের গ্যাস চেম্বারের মতো এক বীভৎস পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিনা উসকানিতে বিএনপির কর্মসূচিতে আক্রমণ করে তারা আবার প্রমাণ করল দেশ এখন দুর্বিনীত দুঃশাসনের করাল গ্রাসে।’

দুই সাংবাদিক লাঞ্ছিত : নয়াপল্টনে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের নির্যাতনে সমকালের স্টাফ রিপোর্টার কামরুল হাসান ও বাংলাদেশ জার্নালের নিজস্ব প্রতিবেদক কিরণ শেখ আহত হন। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। সকাল সাড়ে ১০টায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কিরণ শেখকে নির্যাতন করে পুলিশ। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও পল্টন থানা পুলিশের এএসআই কুবায়েত কিরণ শেখের ওপর নির্যাতন চালান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ করতে নয়াপল্টনে দলটির কার্যালয়ের সামনে আসামাত্রই কয়েকজন পুলিশ সদস্য আমাকে ঘিরে ফেলেন। আমি আইডি কার্ড দেখাই। এরপর পুলিশ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালিসহ কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে আমাকে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর শার্ট ধরে টেনে তোলে। মারধরের কারণ জানতে চাইলে পুলিশ গালে চড় দিয়ে বলে, “একদম চুপ, কোনো কথা বলবি না”।’

দুপুরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী পুলিশ সমকালের স্টাফ রিপোর্টার কামরুল হাসানকে আটক করে হোটেল ভিক্টরির গলিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালসহ তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেয়। এরপর তার ফেসবুক আইডি ঘাঁটাঘাঁটি করে। পরিচয়পত্রের ছবি তুলে বলে, ‘তোকে টার্গেটে রেখেছি।’ এর কিছুক্ষণ পর একই বিটে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিবাদের মুখে কামরুলকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর