রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে দুশ্চিন্তা

মোট রোহিঙ্গার ৯০ শতাংশই বাংলাদেশে!
ইইউ মন্ত্রীরা বসছেন কাল

জুলকার নাইন

বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুতি চলতে থাকলেও থেমে নেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে গিয়েছিলেন নতুন অনুপ্রবেশ বন্ধ করার। কিন্তু এরপর গত এক সপ্তাহে কয়েক শ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। নতুন করে এসব রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ভাবিয়ে  তুলেছে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের। কারণ, কী কারণে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। তবে নতুন আসা রোহিঙ্গারা খাদ্য সংকটের কথা বলছেন। অন্যদিকে, সীমান্তের জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার জেলা প্রশাসক পর্যায়ের বৈঠকেও কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ দেয়নি মিয়ানমার। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, মূলত মিয়ানমারের স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের এপারে চলে আসতে চাপ সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গাদের বলা হচ্ছে, সবাই ওপারে চলে গেছে তোমরাও যাও। আবার কেউ কেউ নিজেদের পরিবারের লোকজনকে খুঁজতে এপারে আসছেন। তবে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া শুরুর পরও যদি এভাবে লোকজন আসতে থাকে তাহলে তা অবশ্যই আমাদের জন্য ভাবনার বিষয়। জানা যায়, ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসা মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল খ সোয়ের কাছে ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা হস্তান্তর করা হয়। আর সেদিনই টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে ৩২ পরিবারের ১৩৬ রোহিঙ্গা। গত শুক্রবারও আসে নতুন ২০০ রোহিঙ্গা। এভাবে চলতি মাসে এসেছে কমপক্ষে ৫৯৩ পরিবারের আড়াই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তারা বলছেন, এসব রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনসহ পারিবারিক তালিকা প্রণয়ন করে ক্যাম্পে অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নতুন করে আসাদের কারণে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন প্রক্রিয়াও শেষ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের উদ্ধৃত করে সরকারি কর্মকর্তারা জানান, রাখাইনের বুসিদং গ্রামে শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবার এপারে না আসার চেষ্টা করে বসতবাড়ি আঁকড়ে ধরে দীর্ঘদিন মিয়ানমারে অবস্থান করছিল। কিন্তু মিয়ানমার সেনাদের আচরণ, ব্যবহার ও তাদের হিংসাত্মক মনোভাব এখনো অপরিবর্তিত। তাদের বাড়ি থেকে বের হতে না দেওয়া ও হাটবাজারে যাওয়া-আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তারা ঘর থেকে বাইরে যেতে পারছে না। এতে অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদের কান্না সইতে না পেরে শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে তারা এপারে চলে আসে। মিয়ানমারের দৈনিক পত্রিকা ইরাবতি গতকাল এক প্রতিবেদনে জানায়, মোট রোহিঙ্গার ৯০ শতাংশই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

সূত্র জানায়, বান্দরবান সীমান্তের তুমব্রু কোনারপাড়া জিরো লাইনে পাঁচ মাস ধরে অবস্থান করছে রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনের শুরুতেই সীমান্তের জিরো লাইনের প্রায় ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য প্রত্যাবাসন কমিটি প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও এদের মিয়ানমারে ফিরতে যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার ভৌমিক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তার সঙ্গে মঙ্গলবার বৈঠক হয়েছে। সেখানে তারা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দ্রততম সময়ের মধ্যে তালিকা করে ফিরিয়ে নেওয়ার। তবে কোনো দিনক্ষণ দেওয়া হয়নি।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাল বসছেন ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা : মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়ে প্রস্তাবনা পাস করতে আগামীকাল বৈঠকে বসছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইইউ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের এ বৈঠকে বসবেন ইউরোপের ২৭ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বৈঠকে রোহিঙ্গা নিপীড়নে দায়ী মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা আসতে পারে। যাদের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে, তাদের নামের একটি তালিকা করতে ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধানকে অনুরোধ জানানো হবে এ বৈঠকে। দুই কূটনীতিকের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এর আগে রোহিঙ্গা নিপীড়নে জড়িত মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের জেনারেলদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি বা তাদের সম্পদ জব্দের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোরতম পদক্ষেপ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, অবিলম্বে সেই প্রস্তাব সামনে আনতে ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেদারিকো মঘেরিনিকে বলবেন জোটের মন্ত্রীরা। মিয়ানমারের ওপর নব্বইয়ের দশক থেকে আরোপিত ইইউর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কীভাবে আরও জোরদার করা যায়, তা খুঁজে দেখতে বলা হবে তাকে। আগামী সোমবার ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের পর এ বিষয়ে একটি বিবৃতি আসতে পারে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গত ১২ ডিসেম্বর থেকে গ্রেফতার রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হতে পারে ইইউর ওই বিবৃতিতে। গতবছর ২৫ আগস্ট রাখাইনে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ঘাঁটিতে হামলার পর সেখানে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াওয়ের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ মানুষ পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সেনাবাহিনীর চরম নিপীড়নের বর্ণনা দিয়েছেন। জাতিসংঘ ওই সেনা অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মিয়ানমারের মেজর জেনারেল মাউং মাউং সোয়েসহ ৫২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে গত ডিসেম্বরে কালো তালিকাভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র।

আরও এলো ৫৮ রোহিঙ্গা : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ভোররাতে ও সকালে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ ও বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ২২ পরিবারের ৫৮ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে ঢুকেছে। টেকনাফের সাবরাং হাড়িয়াখালী ত্রাণ কেন্দ্রে দায়িত্বরত জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি ও টেকনাফ উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, গতকাল সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নতুন করে এসেছে ২২ পরিবারের ৫৮ জন রোহিঙ্গা। এদের প্রথমে সেনাবাহিনীর হাড়িয়াখালী ত্রাণ কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এরপর মানবিক সহায়তা ও প্রতিটি পরিবারকে চাল, ডাল, সুজি, চিনি, তেল, লবণের একটি করে বস্তা দিয়ে গাড়িযোগে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠানো হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর