বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

শেয়ার ইস্যুতে জড়িয়ে যাচ্ছে চীন-ভারত

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে চীন ও ভারতভিত্তিক দুটি কনসোর্টিয়ামের প্রতিযোগিতার মধ্যে এবার দেশ দুটিই জড়িয়ে পড়েছে। চায়না দূতাবাস থেকে বাংলাদেশ  সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, ডিএসইর অংশীদারিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেন যথাযথ আইন ও নীতি অনুসরণ করা হয়। আর ওই চিঠির ওপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নোট লিখেছেন, ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার হওয়ার বিষয়ে চীনা কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা নিয়েই তার সন্দেহ রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকাস্থ চাইনিজ দূতাবাসের ইকোনমিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল কাউন্সিলর লি গুয়াংজান বিএসইসিতে এই চিঠি পাঠান। অর্থমন্ত্রীকেও ওই চিঠির কপি পাঠায় চায়না দূতাবাস। সূত্রগুলো জানায়, একটি স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার কেনার বিষয়ে দূতাবাসের এ ধরনের চিঠি দেওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক কর্মকর্তা জানান, রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন মেনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে দূতাবাস থেকে সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থায় চিঠি পাঠানোর বিষয়টি স্বাভাবিক এবং সৌজন্যমূলক নয়। কারণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজই হচ্ছে আইন ও নীতি অনুসরণ করা। চাইনিজ দূতাবাসের চিঠিতে বলা হয়, ‘ডিএসইর আহ্বানে সাড়া দিয়ে চাইনিজ কনসোর্টিয়াম শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ (এসজেডএসই) ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ (এসএসই) কৌশলগত অংশীদার হওয়ার জন্য দরপত্র জমা দিয়েছে। আমরা আশা করছি, বিএসইসি তার আইন ও নীতি অনুযায়ী সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেবে যাতে আমরা দুই পক্ষই লাভবান হতে পারি।’ সূত্রগুলো জানায়, চীনের পক্ষ থেকে যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে ডিএসইর অংশীদার হওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হচ্ছে, তেমন ভারতের দিক থেকেও তাদের কনসোর্টিয়ামকে অংশীদার করার জন্য বিএসইসিকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। ভারতের একটি গ্রুপ বিষয়টি নিয়ে বিএসইসির ওপর তাগিদ অব্যাহত রেখেছে বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকার পুঁজিবাজারের কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো ধরনের তদবির অবাঞ্ছিত। চীন, ভারত যে কোনো দেশ থেকেই তদবির আসুক তা মেনে নেওয়ার মতো নয়। তিনি বলেন, ডিএসই ডি-মিউচুয়ালাইজেশনের শর্ত হিসেবে বলা ছিল ২৫ শতাংশ শেয়ার বাইরের কোনো কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে, যাতে তারা এই পুঁজিবাজারের সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে তদবির শুরু হয়েছে তা অনাহুত। এ ক্ষেত্রে বিএসইসির উচিত হবে নিজস্ব শর্ত ও নীতি মেনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে পুঁজিবাজারের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে।

গত সেপ্টেম্বরে ডিএসইর ডাকা শেয়ার বিক্রির দরপত্রে অংশ নিয়ে চীনের জোটটি প্রতিটি শেয়ারের জন্য সর্বোচ্চ ২২ টাকা দরপ্রস্তাব করে। আর ভারতের জোটটি প্রতিটি শেয়ারের দরপ্রস্তাব করে ১৫ টাকা। চীনের জোটে রয়েছে দেশটির সেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ। অন্যদিকে ভারতের জোটে রয়েছে দেশটির ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই), যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাক ও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ। এ দুই জোটের মধ্যে দরপ্রস্তাবে এগিয়ে রয়েছে চীনের সেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ জোটটি। আর এ কারণে চীনের জোটটিকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে পেতে চাইছে ডিএসই। ২২ ফেব্রুয়ারি কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে শেয়ার বিক্রিসংক্রান্ত প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিএসইসির কাছে আবেদন জমা দিয়েছে ঢাকা পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ। এ প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের জন্য চার নির্বাহী পরিচালকের সমন্বয়ে একটি পর্যালোচনা কমিটি করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাটি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

কৌশলগত অংশীদার করতে চীনের সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রস্তাবের বিষয়ে ডিএসইর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বিএসইসি। জানা গেছে, চায়না কনসোর্টিয়ামের দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে অন্তত ১৫টির বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে গত মঙ্গলবার ডিএসইকে চিঠি দেয় বিএসইসির পর্যালোচনা কমিটি। আগামী রবিবারের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, চায়না কনসোর্টিয়াম ডিএসইকে যে কোনো ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তির শর্ত দিয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ কোটি টাকার প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে চীনা কনসোর্টিয়াম যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে বিষয়েও ডিএসইর আবেদনে নিরপেক্ষ কোনো মূল্যায়ন নেই। কৌশলগত অংশীদারের জন্য ডিএসইর বার্ষিক সাধারণ সভার আগে ১৩টি বিষয়ে চীনা কনসোর্টিয়ামের লিখিত অনুমোদন দরকার হবে বলে মনে করছে বিএসইসির পর্যালোচনা কমিটি। এর মধ্যে রয়েছে যে কোনো নতুন শেয়ার ইস্যু, পরিচালকদের সংখ্যা পরিবর্তন, নতুন কোনো কৌশলগত বিনিয়োগকারী অন্তর্ভুক্তকরণ এবং একক বা যৌথভাবে ১০ কোটি টাকার অধিক ঋণ গ্রহণ। চায়না কনসোর্টিয়ামের এসব শর্ত বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে বিএসইসি এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা রুটিনমাফিক কিছু ব্যাখ্যা চেয়েছে। আমরা নির্ধারিত সময়ে জবাব দেব।’ যুক্তরাজ্যের আইন মেনে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে ডিএসইর এই কর্মকর্তা জানান, যে কোনো ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে বিরোধ মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারস্থ হতে হয়। কেউ ব্রিটিশ আইন মেনে বিরোধ নিষ্পত্তি করে, কেউ জেনেভা আইন মেনে করে। আমরা চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আইনে নিষ্পত্তি চেয়েছি। ৩০০ কোটি টাকার নিরপেক্ষ মূল্যায়ন বিষয়ে ডিএসইর এমডি বলেন, এর কোনো প্রয়োজন নেই বলে আমরা আবেদনপত্রে এ ধরনের কোনো মূল্যায়ন যোগ করিনি। কারণ চীন এই অর্থ আমাদের ‘ফ্রি’ দিতে চেয়েছে।  তারা বলেছে, ১০ বছরের জন্য এই টাকাটা আমাদের সহায়তা হিসেবে দেবে। আমরা যদি তাদের টাকাটা নিই তখন এ ক্ষেত্রে মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়বে। ওই সহায়তা নেওয়া হবে কিনা সেই সিদ্ধান্তই তো এখনো হয়নি। স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক করা-সংক্রান্ত ডি-মিউচুয়ালাইজেশন আইন অনুযায়ী, ডিএসইর মোট শেয়ার ২৫০ সদস্যের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হয়। এসব শেয়ারের মধ্যে ৪০ শতাংশ সদস্যদের নিজেদের জন্য আলাদা করা হয়। বাকি ৬০ শতাংশ শেয়ার সদস্যদের বাইরে বিক্রির জন্য আলাদা করে রাখা হয়। এই ৬০ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ২৫ শতাংশ বা ৪৫ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ১২৫টি শেয়ার কৌশলগত বা স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট করা আছে। আইন অনুযায়ী, আগামী ৮ মার্চের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সময়ের ভিতরে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। আইনে ডিএসইর পর্ষদে কৌশলগত বিনিয়োগকারীর জন্য একটি পরিচালক পদও সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর