শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

কোনোভাবেই থামছে না অর্থপাচার

বাড়তি ৭৫ শতাংশ মেশিনারিজ ও কটন আমদানিতে সন্দেহ বাড়ছে রপ্তানিতে পুরো অর্থ আসছে না মুনাফা থাকছে বিদেশে

রুহুল আমিন রাসেল

কোনোভাবেই থামছে না অর্থপাচার

কোনোভাবেই থামছে না অর্থপাচার। অতীতের মতো এবারও নির্বাচনের আগে অর্থপাচার হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ও গবেষকরা। তাদের মতে, অজানা রাজনৈতিক আশঙ্কায় অনেকেই উন্নত বিশ্বে সুখে থাকার স্বপ্ন দেখছেন। গড়ে তুলছেন সম্পদের পাহাড়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ এমন অর্থের বিনিয়োগ উৎসাহিত করছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ পাচার ঠেকাতে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ ইতিবাচক।

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবার নির্বাচনের বছরে অর্থপাচার ঠেকানোর উদ্যোগের কথা জানিয়ে গতকাল বলেন, একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানোর পর সে ফাইল দেখবে এনবিআর। এজন্য সন্দেহজনক লেনদেন দুই প্রতিষ্ঠানই খতিয়ে দেখবে। দুই প্রতিষ্ঠান মিলে তথ্যের আদান-প্রদান করব। যখন যে ধরনের সমস্যা দেখব, তা আমলে নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ থাকবে। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়, যেমন— অবৈধ লেনদেন, সন্দেহজনক এলসি বা ঋণপত্র খোলা, আমদানি-রপ্তানিতে সন্দেহ, কোনো প্রতিষ্ঠানের হঠাৎ অনেক আমদানি— তখন এনবিআর দেখবে পণ্য ঠিকমতো আসছে কিনা।

জানা গেছে, শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের আড়ালে এবং আমদানি— রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বেশি অর্থপাচার হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিল্পখাতে বাড়তি মেশিনারিজ ও ৭৫ শতাংশ কটন আমদানিতে সন্দেহ বাড়ছে। আবার রপ্তানির পুরো অর্থ বাংলাদেশে আনা হচ্ছে না। কেউ কেউ ব্যবসা থেকে মুনাফার বড় অংশই বিদেশে রেখে সম্পদ গড়ে তুলছেন। ফলে বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের দাম কমলেও, বাংলাদেশে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে চার টাকা। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকার পরও প্রাইমারি টেক্সটাইল শিল্পে আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ার তথ্য দিয়েছে, এই খাতের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন— বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। এনবিআর সূত্র জানায়, পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিষয় খতিয়ে দেখছেন কর গোয়েন্দারা। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে নাম আসা ব্যক্তিদের বিষয়ে বিএফআইইউ’র সঙ্গে এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের গোয়েন্দারা কাজ করছে। অর্থপাচারের বিষয়ে অনেক দিন ধরে কাজ হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। অধিক তদন্তের জন্য অর্থপাচারের কয়েকটি ঘটনা দুদকেও পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের অন্য সংস্থাগুলো থেকেও তথ্য আসছে এনবিআরে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের কারণ মূলত তিনটি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলে অর্থপাচারও বেড়েছে। এ ছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ—সিপিডির বিশেষ ফোলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান গতকাল বলেন, অনিশ্চয়তার মুখে অর্থপাচারের আশঙ্কা থাকে। আর নির্বাচনের বছর অর্থপাচার বেশি হয়। এবার ইতিবাচক দিক হলো— বাংলদেশ ব্যাংক ও এনবিআর একটি যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্থা দুটি কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছে। যা আশাবাদের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল বলেন, অর্থপাচারকারীদের অনেকেই চেনে। বিভিন্ন সংস্থার লোকজনও চেনে এবং জানে। এদের ধরাও সহজ। যারা অবৈধভাবে টাকা বানাচ্ছে, তারাই পাচার করছে। ব্যাংকে সন্দেহজনক লেনদেনেও নজরদারি রাখা সম্ভব। কারণ— আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অর্থপাচার হয়। আরেকটি প্রক্রিয়া হলো— হুন্ডি। গত বছর রপ্তানির চেয়ে আমদানি ১৯ শতাংশ বেশি হয়েছে। এই আমদানির মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। এই প্রক্রিয়াতেই পাচার বেশি হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিচালক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের বছরে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার বেড়ে যাওয়ার কারণে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় চলে যাচ্ছে প্রচুর অর্থ। অনেকে ভুয়া এলসি (ঋণপত্র) অথবা ওভার ইন-ভয়েসের মাধ্যমেও অর্থপাচার করছেন। প্রতিবছর বিভিন্নভাবে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়। যেসব মাধ্যম ও পথ ব্যবহার করে অর্থপাচার হচ্ছে, এবার সেসব পথ বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এজন্য এনবিআরের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)। অর্থপাচারের মাধ্যমগুলো শনাক্ত ও বন্ধ করার পাশাপাশি এই চুক্তির লক্ষ্য হলো— আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে পাচার হওয়া অর্থ বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সংস্থা দুটির কর্মকর্তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও কাজ করছেন। সর্বশেষ ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি—জিএফআই ২০১৭ সালের ১ মে প্রকাশিত ‘উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অর্থপাচার : ২০০৫-২০১৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ১০ বছরে পাচার হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। পাচারের অর্থে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করা এবং কানাডায় বেগম পাড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশিরাই। তবে বাংলাদেশ থেকে শুধু অর্থ পাচার হয়ে বাইরে যায়নি, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৩৪ থেকে ৬১ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে এসেছে।

সর্বশেষ খবর