শিরোনাম
শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

তিন মাসেও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন

সীমান্তের শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদেরও নিচ্ছে না মিয়ানমার

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই দেশের চুক্তির তিন মাস পার হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। দ্বিপক্ষীয় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও দফায় দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনো কার্যকর হচ্ছে না। ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরুর সময়কাল ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও কার্যত তা এখনো বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বৈঠক হলে এতেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর পক্ষে মত দেন মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিয়াও সুইকফি। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি প্রতিনিধিদলের এক বৈঠকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও গতকাল পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। উপরন্তু এখানকার বেশ কিছু রোহিঙ্গা পরিবার পালিয়ে বাংলাদেশের  আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে গত কয়েক দিনে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে এ সংশয়। স্বয়ং রোহিঙ্গা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনও (আরআরআরসি) জানে না সত্যিকার অর্থে কবে নাগাদ কার্যকর হবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করছে আরআরআরসি। এদিকে মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত ছয় মাসে তাদের সেনা-নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিও হয়েছে। এর পরপরই দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের নিয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপও গঠিত হয় প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করার জন্য। এই গ্রুপ চুক্তির দুই মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ২২ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর ঘোষণাও দেয়। চুক্তির আওতায় প্রতিদিন ৩০০ করে সপ্তাহে ১৫০০ রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার ঘোষণা দেয় মিয়ানমার সরকার। কিন্তু ২২ জানুয়ারির সেই নির্ধারিত দিনেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য প্রস্তুতকৃত ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকাও তুলে দেওয়া হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি। এর পরও মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা প্রত্যাবাসনের কথা বলে এলেও এখনো প্রায় প্রতিদিন মিয়ানমার সেনাদের অত্যাচার ও ভয়ের মুখে পালিয়ে আসছে নিঃস্ব রোহিঙ্গারা। এতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সুদূরপরাহতই থেকে যাচ্ছে।

আরআরআরসির সহকারী কমিশনার মো. শামসুদ্দোজা বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা আশাবাদী। কিন্তু একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। তাই সময় লেগে যাচ্ছে। আমরা ২০ ফেব্রুয়ারি তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় গিয়েছি। এই শূন্যরেখার ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি মিয়ানমার প্রতিনিধিদলকে। তারাও সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ এ প্রক্রিয়া শুরু হবে তা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে।’

বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, গত বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এরও আগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে আরও প্রায় চার লাখের মতো। সব মিলিয়ে এখন প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান বাংলাদেশে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণের দায়ভারও এখন বাংলাদেশ সরকারের। তাই এ সংকট নিরসন না হওয়া পর্যন্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি শক্ত পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ত্রাণের ওপরই একমাত্র নির্ভরশীল এত বিশাল এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে অদূরভবিষ্যতে ত্রাণ বা এনজিও সংস্থাগুলোকেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাঠপর্যায়ে কর্মরত দেশীয় উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এখানে প্রটেকশন ব্যবস্থা দরকার। কারণ এখানে কোনো আইন নেই। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে, ট্রাফিকিংয়ের মতো মারাত্মক হুমকির শিকার হচ্ছে। গত ৬ মাস হয়তো আন্তর্জাতিক ও দেশি সংস্থাগুলো কাজ করেছে। কিন্তু এরপর কী হবে তা নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করতে হবে। এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন ও শরণার্থী সংকট চললেও চলমান রোহিঙ্গা সংকটকেই সবচেয়ে ভয়াবহ বলে মনে করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সিরিয়া, ইয়েমেন, নাইজেরিয়ার মানবিক সংকটে কাজ করা বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট হচ্ছে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট। এত দ্রুততম সময়ে এত বড় জনগোষ্ঠী এত ছোট জায়গায় পৃথিবীর কোথাও আশ্রয় নেয়নি, যে ঘটনায় স্থানীয় অধিবাসীরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন। আর এ কারণে স্থানীয় জনগণের জন্যও কাজ শুরু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এমনটাই মনে করছেন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কর্মরত দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার লোকেরা। তাদের মতে, এ ঘটনার শুরুর দিকে যে সহানুভূতি নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ, স্বাভাবিকভাবে সেটা কমছে দ্রুত। স্থানীয়রাও নতুন নতুন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন।

অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর কারণে এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও বিপরীতে স্থানীয় লোকদের কাজের মজুরি আগের চেয়ে কমে গেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক নানা কারণে বিরূপ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত ছয় মাসেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় এখন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে। এই ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে এখনো কাজ করছেন উভয় দেশের প্রতিনিধিরা। একটু সময় লেগে যাচ্ছে তা ঠিক, কিন্তু প্রত্যাবাসন শুরু হবে শিগগিরই। যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারা ফিরে না যায়, তাহলে এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। সরকারের মন্ত্রণালয় পর্যায়ে এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর