রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
গেরুয়া ঝড়ে লাল বিপর্যস্ত

ত্রিপুরায় সরকার গড়ছে বিজেপি

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

‘চলো পাল্টাই’— ছোট্ট এই স্লোগানেই ত্রিপুরার লাল দুর্গে বাজিমাত করল পদ্মফুল প্রতীকের গেরুয়া শিবির। দীর্ঘ ২৫ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সরকার গড়ছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জোট সরকার। রাজ্যটির ৫৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপি ও ইন্ডিজিনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি) জোট ৪৩টি আসনে এগিয়ে রয়েছে (ইতিমধ্যে ম্যাজিক ফিগার (৩১) অতিক্রম করে ৩৩ আসনে জয় পেয়েছে)। বামফ্রন্ট ১৬টি আসনে এগিয়ে। কংগ্রেস কার্যত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। এবার তাদের ঝুলিতে একটি আসনও আসেনি। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ৬০ আসনের ত্রিপুরা বিধানসভার ৫৯টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চড়িলাম কেন্দ্রের সিপিআইএম প্রার্থী রমেন্দ্র নারায়ণ দেবের মৃত্যুর কারণে ওই আসনটিতে ভোট নেওয়া হবে আগামী ১২ মার্চ। এরপর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শনিবার সকাল ৮টা থেকে ভোট গণনা শুরু হয়। সকালের দিকে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে জোর লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেলেও বেলা গড়াতেই সিপিআইএম, কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় বিজেপি। অথচ ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ১.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল গেরুয়া শিবির। সেবার রাজ্যের ৪৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রতিটি আসনেই তাদের জামানত জব্দ হয়েছিল। অন্যদিকে ৫৫টি আসনে প্রার্থী দিয়ে সেবার ৪৯ আসনে জয় পেয়ে সরকার গড়ে সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। ৪৮ আসনে প্রার্থী দিয়ে ১০ আসনে জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। যদিও মোদি হাওয়ায় ভর করে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যটিতে ৫.৭০ শতাংশ ভোট পায় বিজেপি।

তারপর থেকেই বাম শাসিত এই রাজ্যে পদ্মের প্রভাব পড়তে থাকে। অন্যদিকে কংগ্রেসের শক্তি ক্রমশ তলানিতে ঠেকে।

লোকসভা নির্বাচনের পরই উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশে ক্ষমতা দখল করে বিজেপি। সেই থেকেই এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে এই দলটি। এবারও নির্বাচনী প্রচারণায় এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতারা ত্রিপুরায় পরিবর্তনের ডাক দেন। এবারের প্রচারণায় গেরুয়া শিবিরের স্লোগানই ছিল ‘চলো পাল্টাই’। প্রচারণায় এসে বাম শাসনের দুর্নীতি, অরাজকতার অভিযোগ তোলেন বিজেপি নেতারা। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় স্তরে মজুরি নির্ধারণ, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের সপ্তম বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধিসহ একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে বামদের ভরসা ছিল স্বচ্ছভাবমূর্তির ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। দীর্ঘ ২৫ বছরের বাম জমানায় বিশ বছর একটানা মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। অনেকে এই লড়াইকে মোদি-মানিকের লড়াই বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু একা মানিক সরকারের ওপর যে আর রাজ্যের মানুষের ভরসা নেই, তা আগেই বোঝা গিয়েছিল। রাজ্যে যে পালাবদল ঘটতে চলেছে তার ইঙ্গিত মিলেছিল বিভিন্ন সংস্থার বুথ ফেরত জরিপগুলোতেও। আর ফলাফল ঘোষণার পরই তা সত্যি হলো। বিজেপির কাছে ত্রিপুরার নির্বাচন ছিল কার্যত প্রেস্টিজ ফাইট। কারণ এই প্রথম দেশের ৬৫ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে কোনো রাজ্যে বামদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই হলো বিজেপির। বিজেপির তরফে গোটা দেশে বার্তা দেওয়ার জন্য ত্রিপুরায় ক্ষমতায় আসা যেমন জরুরি তেমনি সিপিআইএম তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং একই সঙ্গে জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে অক্সিজেন জোগাতেও এ রাজ্যে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা খুবই জরুরি ছিল তাদের কাছে। অন্যদিকে বিজেপির এই উত্থানে ত্রিপুরায় কার্যত সাইনবোর্ডে পরিণত হয়ে গেল শতবর্ষ পুরনো দল জাতীয় কংগ্রেস।

ত্রিপুরায় জয়ের পরই ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালার পাশাপাশি দিল্লিতেও বিজেপির কর্মীরা আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে। আবির খেলার পাশাপাশি চলে মিষ্টি মুখের পালা।

ত্রিপুরায় বিজেপির এই জয়ে উচ্ছ্বাস জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। এই জয়কে গণতন্ত্রের জয় বলে আখ্যায়িত করেছেন মোদি। এই জয়ে রাজ্যের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন দলটির রাজ্য সভাপতি বিপ্লব কুমার দেব। তিনি জানান ‘রাজ্যেও মানুষ যে দায়িত্ব দিয়েছে আমি সেটা পালন করেছি। আমাদের কাজ হবে রাজ্যে সুশাসন, উন্নয়ন, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা’।

বিজেপি নেতা ও আসামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মানিক সরকারকে কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ অথবা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। শনিবার আগরতলায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন। অন্যদিকে সিপিআইএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির অভিযোগ, ‘রুপি ছড়িয়ে ও অন্য প্রভাব খাটিয়ে ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে।’ ত্রিপুরায় জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে হেভিওয়েট প্রার্থীদের রয়েছেন স্বাস্থ্য ও পূর্ত দফতরের মন্ত্রী বাদল চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী তপন চক্রবর্তী, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী ভানুলাল সাহা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিপ্লব কুমার দেব, বিজেপির সুদীপ রায় বর্মণ, রতন লাল নাথ, আইপিএফটি প্রার্থী এন সি দেববর্মা প্রমুখ। রাজ্যটির চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও তার বিপক্ষের থেকে এগিয়ে রয়েছেন। বিজেপির দাপটে এবার ত্রিপুরার অনেক হেভিওয়েট মন্ত্রীই জয়ের স্বাদ পাননি। এর মধ্যে রয়েছেন রাজ্যটির উপজাতি কল্যাণমন্ত্রী অঘোর দেববর্মা, হেরেছেন কংগ্রেসের বিরজিত সিনহা। ত্রিপুরার পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের আরও দুই রাজ্য নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়েও এ দিন বিধানসভার ভোটের ফলাফল বের হয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এই দুই রাজ্যে ভোট গ্রহণ হয়। ৬০ আসনবিশিষ্ট নাগাল্যান্ডেও সরকার গঠনের পথে বিজেপি জোট। সরকার গঠনের জন্য দরকার ৩১ আসন। সেখানে বিজেপি ও ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (এনডিপিপি) ও বিজেপি জোট ৩২টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। রাজ্যটির শাসক দল নাগাল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট (এনপিএফ) এগিয়ে রয়েছে ২৪ আসনে। অন্যরা ৪টি আসনে এগিয়ে। কংগ্রেস শাসিত মেঘালয়ে ৬০টির মধ্যে ৫৯ আসনে ভোট হয়েছে (একটি আসনে এনসিপি প্রার্থীর মৃত্যুতে ভোট স্থগিত আছে)। কিন্তু এই রাজ্যে কোনো দলই সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না বলেই ধারণা। সরকার গঠনের জন্য দরকার ৩১ আসন, সেখানে এখন পর্যন্ত কংগ্রেস এগিয়ে রয়েছে ২১টি আসনে। পিএ সাংমার দল ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ১৯, অন্যরা ১৭টি এবং বিজেপি ২ আসনে এগিয়ে রয়েছে। জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে আছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস প্রার্থী মুকুল সাংমা (আমপাথি ও সংসাক কেন্দ্র), মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী ডিকাঞ্চি ডি শিরা, রাজ্যটির পূর্তমন্ত্রী কংগ্রেস প্রার্থী মাজেল আম্পারিন লিংডো। পরাজিতদের মধ্যে আছেন রাজ্যটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেস প্রার্থী এইচ ডনকুপার আর লিংডো। তিন রাজ্যে ভোটের ফলাফলে আগামী বছরে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি অনেকটাই শক্তিশালী হলো সে কথা বলাই যায়। কারণ তিন রাজ্যের ভোটের এই ফলাফল শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতই নয়, ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সর্বশেষ খবর