রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

এখনো উত্তেজনা মিয়ানমার সীমান্তে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের টহল অব্যাহত থাকায় উত্তেজনা কমছে না। সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যেমন প্রতিমুহূর্ত আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন, তেমনি সীমান্তবর্তী সাধারণ বাঙালিরাও রয়েছেন আতঙ্কে। অনেকে গত তিন দিনের উত্তেজনায় নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে দূরবর্তী আত্মীয়বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। যারা রয়েছেন তাদের অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে। সীমান্তের শূন্যরেখায় থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর এখনো মানসিক চাপ প্রয়োগ ও হুমকি অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার সেনা ও সে দেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, সীমান্তে সেনা মোতায়েন আসলে রোহিঙ্গাদের মনে ভীতি সঞ্চারের অপচেষ্টা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আগামী ২৭ মার্চ থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সীমান্তে যৌথ টহল দেবে।

স্থানীয় অধিবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার থেকে শুক্রবার পতাকা বৈঠকের আগ পর্যন্ত দিনে অন্তত ১০ থেকে ১৫ বার লাউড স্পিকারে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের প্রতি হুমকি দিয়েছে মিয়ানমার সেনারা। এতে ভয়ে অন্তত ১৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের ভিতরে প্রবেশ করেছে। এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শনিবার ৩ নম্বর ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিকের নেতৃত্বে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে। জানা গেছে, তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় নিজেদের বানানো অস্থায়ী ক্যাম্প ছেড়ে গত তিন দিনে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতারা জানিয়েছেন, লাউড স্পিকারে মিয়ানমার সেনা সদস্যদের দেওয়া হুমকি এবং অব্যাহত সেনা টহলের মুখে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এরই মধ্যে মিয়ানমার সেনারা সীমান্তের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি স্থানে বাঙ্কারও নির্মাণ করেছে। অনেকটা যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি তৈরি করে মিয়ানমার সীমান্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। শুক্রবার বিকালে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাজনিত কারণে সীমান্তে সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে বলে জানায় মিয়ানমার। এ ছাড়া শূন্যরেখা টার্গেট করে গুলি ছোড়ার বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। বৈঠকের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও গতকালও বেশ উত্তেজনা এবং আতঙ্ক ছিল নাইক্ষ্যংছড়ির এই সীমান্ত এলাকাজুড়ে। তুমব্রুর পাশাপাশি জলপাইতলী, ঘুমধুম সীমান্তবর্তী বসতবাড়িগুলোতেও রয়েছে এই আতঙ্ক। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক বৈঠকে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা তথা আর কোনো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর অবস্থান ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তুমব্রু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কামাল উদ্দিন। এদিকে তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি রেখেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মিয়ানমার সেনা ও বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সীমান্ত এলাকায় কী করছে, কী পদক্ষেপ নিচ্ছে— তা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখার জন্য সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পতাকা বৈঠক হওয়ার পরও সীমান্ত এলাকা থেকে সরে যায়নি মিয়ানমার সেনারা। মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট এলাকার চেয়ারম্যান এশার আলম বলেন, ‘শুক্রবার সকালে সাতটি বড় গাড়ি ও তিনটি ছোট গাড়িতে করে মিয়ানমারের প্রায় ২০০ বিজিপি ও সেনা সদস্য জিরো পয়েন্টে টহল দেওয়া শুরু করে। এরপর থেকে গতকাল পর্যন্ত তারা পালা পরিবর্তন করে টহল অব্যাহত রেখেছে বলে জানা গেছে। শুক্রবার বিকালে মিয়ানমার সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকের বরাত দিয়ে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, ‘মিয়ানমার বিজিপি ও সেনা সদস্যরা সীমান্ত এলাকায় যা করছে তা আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের শামিল। বিষয়টি আমরা তাদের বলেছি। ফাঁকা গুলি ছোড়ার বিষয়েও জানতে চেয়েছি। তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার খাতিরে তা করেছে বলে জবাব দিলেও ভবিষ্যতে তারা যে কোনো বিষয়ে বাংলাদেশকে অবহিত করবে বলে কথা দিয়েছে।’ এদিকে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আতঙ্ক কাটছে না স্থানীয় সাধারণ বাসিন্দাদের। অনেকে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মুখোমুখি এই অবস্থানের মধ্যে অসহায় হয়ে পড়েছে শূন্যরেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গা ও এলাকার সাধারণ মানুষ। তুমব্রু কোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, ‘বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তিন ছেলের সংসারে স্ত্রী-নাতিসহ রয়েছে ১১ জন সদস্য। গত তিন দিন ধরে রাতে সীমান্ত এলাকায় বার্মার সেনাবাহিনীর গুলির কারণে যুদ্ধের ভয়ে কক্সবাজার জেলার রামুর আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছে তারা। আমি আছি গরু-ছাগল ও বাড়ি দেখাশোনার জন্য।’

২৭ মার্চ থেকে যৌথ টহল : রাজধানীর ফার্মগেটে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মিয়ানমার তুমব্রু সীমান্ত থেকে ভারী অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছে। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে মিয়ানমার সীমান্তে  সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল। এখন সীমান্ত থেকে ভারী অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছে তারা। তিনি বলেন, এখন সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। আগামী ২৭ মার্চ থেকে পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী বিজিবি ও বিজিপি সীমান্ত এলাকায় যৌথ টহল দেবে। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা খুব দ্রুত নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ভীত করার অপচেষ্টায় মিয়ানমার : শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এমপি বলেছেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এটা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সহজে ফেরত নিতে চাইবে না। আজকে আন্তর্জাতিক চাপ এবং বাংলাদেশের লবিংয়ের কারণে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু যাদের ফেরত নেওয়া হবে, সেই রোহিঙ্গারা যাতে ফিরতে আগ্রহী না হয়, সে জন্য মিয়ানমার সীমান্তে ভীতি প্রদর্শন করে রোহিঙ্গাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে একটা অবস্থার সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন শিল্পমন্ত্রী আমু। গতকাল বরিশাল নগরীর বরিশাল ক্লাব চত্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আয়োজিত বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা কনফারেন্সের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন আমু।

সর্বশেষ খবর