মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম তিন সমঝোতা

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে পাশে থাকার আশ্বাস

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে পাশে থাকার আশ্বাস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল তার কার্যালয়ে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াংকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান —বাংলাদেশ প্রতিদিন

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যন্ত্র প্রকৌশল খাতে সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ে তিনটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। গতকাল (সোমবার) ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং। সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটান ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাউ কুয়াং। তিনি সকাল ৮টায় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু করেন। পরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছান ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট। সকাল ১০টায় ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনা তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। দুই নেতার মধ্যে একান্ত বৈঠক শেষে শুরু হয় দ্বিপক্ষীয়  বৈঠক। সেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভিয়েতনামের পক্ষে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান ত্রান দাই কুয়াং। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করবী হলে দুই নেতার উপস্থিতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যন্ত্র প্রকৌশল খাতে সহযোগিতাসহ তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সহযোগিতার বিষয়ে ২০১২ সালে দুই দেশের মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক হয়েছিল, এবার তা নবায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবং ভিয়েতনামের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী নুয়েন জুয়ান সেউয়ং এই সমঝোতা স্মারকে সই করেন। মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং ভিয়েতনামের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার কাও চুয়ক হুয়াং একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেন। আর সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান ও ভিয়েতনামের সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টার ড্যাং থাই বিচ লিয়েন তৃতীয় সমঝোতা স্মারকে সই করেন। এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। বৈঠকে এই ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের সমর্থনও চেয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতি ত্রান দাই কুয়াং কার্যকর ও স্থায়ী সমাধানের সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভিয়েতনাম আমাদের কাছের প্রতিবেশী। শান্তি ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে এই দুই দেশ এক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। উভয় দেশের জনগণও একই ধরনের রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের অংশীদার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন জনগণের স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন দিয়েছেন। নিপীড়ক বাহিনীর বিরুদ্ধে ভিয়েতনামি মানুষের লড়াই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই দুই দেশের মানুষ একই ঐতিহ্য, মূল্যবোধ লালন করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ষাটের দশকে শিক্ষাজীবনে আমি নিজে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ র‌্যালিতে অংশ নিয়েছি। রাষ্ট্রপতি ত্রান দাই এবং আমি আমাদের আলোচনার সময় আমরা সহযোগিতার নতুন এলাকাগুলো চিহ্নিত করেছি। প্রধানমন্ত্রী আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব সৃষ্টির আগ্রহ প্রকাশ করে ‘মেকং-গঙ্গা’ সহযোগিতা ফোরামে যোগদানে আগ্রহের কথাও জানান। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হতে এবং ‘মেকং-গঙ্গা’ ফোরামে যোগদানের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে এ বিষয়ে ভিয়েতনামের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট কুয়াংকে জানিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও ফ্লাইটের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাসহ সমুদ্র ও মহাসাগরের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং নিয়ম-ভিত্তিক আদেশ বজায় রাখায় জন্য বিশ্বাস করে। আমরা ১৯৮২ সালের কনভেনশন মতে সব সমুদ্র আইন (ইউএনক্লজ) অনুযায়ী আঞ্চলিক ও সমুদ্রবিরোধসহ সব আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে আস্থাশীল।

বঙ্গবন্ধু ও শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা : ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং গতকাল সকালে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এবং ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন। ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে এসে পৌঁছলে বঙ্গবন্ধুর নাতি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি তাকে স্বাগত জানান। কুয়াং জাদুঘরের বিভিন্ন কর্নার ঘুরে দেখেন। এ সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ববি এ সময় জাদুঘরের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর লেখা কয়েকটি গ্রন্থ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টকে উপহার দেন। এরপর কুয়াং বঙ্গবন্ধু ভবনের পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এর আগে সকালে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি দেশের জন্য আত্মদানকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ সময় কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রেসিডেন্ট কুয়াং স্মৃতিসৌধে পৌঁছলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন তাকে স্বাগত জানান। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য, নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রেসিডেন্ট কুয়াংকে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় তিনি সেখানে পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন।

দিনভর কর্মসূচি : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে হোটেলে ফিরলে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গতকাল বেলা আড়াইটায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বিকাল তিনটায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্স পরিদর্শনে যান ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট। সেখানে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তার সঙ্গে বৈঠক করেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তার সম্মানে আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। সফরের তৃতীয় ও শেষ দিন আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টায় বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ প্রধান ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। পরে তিনি ভিয়েতনাম-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের বৈঠক এবং ‘ভিয়েতনাম কালচারাল ডেজ ইন বাংলাদেশ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। দুপুরের পরপরই প্রেসিডেন্ট কুয়াং ঢাকা ত্যাগ করবেন।

সংসদ ভবন পরিদর্শন স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক : বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে মৈত্রী গ্রুপ গঠন ও আইটিসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোনে ভিয়েতনামকে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বাংলাদেশ সফররত ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াংয়ের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সংসদ ভবনে গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ আহ্বান জানান। জবাবে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ত্রান দাই কুয়াং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করেন।

 এর আগে প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে পৌঁছলে স্পিকার স্বাগত জানান। চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. আবদুর রব হাওলাদার এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভবন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তিনি সংসদ ভবনের স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হন ও প্রশংসা করেন। এ সময় প্রতিনিধি দলকে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা, অধিবেশন কক্ষসহ সংসদ ভবনের বিভিন্ন লবি ঘুরে ঘুরে দেখানো হয়। বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে মৈত্রী গ্রুপ গঠন এবং সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সফর ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে দুই দেশের পার্লামেন্ট উপকৃত হতে পারে বলে উল্লেখ করেন স্পিকার।

সর্বশেষ খবর