মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আবাসিক এখন বাণিজ্যিক এলাকা

রাজউকের সিন্ডিকেট গুলশান বনানী ধানমন্ডি লালমাটিয়া উত্তরায় যেখানে সেখানে হোটেল রেস্টুরেন্ট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিচ্ছে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট নাগরিক দুর্ভোগ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

আবাসিক এখন বাণিজ্যিক এলাকা

আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিকীকরণের উৎসবে মেতেছে রাজউকের কতিপয় সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের যোগসাজশে রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, উত্তরার মতো আবাসিক এলাকাগুলোতে গড়ে তোলা হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আবাসিক চেহারা ও নাগরিক সুবিধা হারিয়ে এসব এলাকা পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক এলাকাতে। গুলশান-বনানীর মতো এলাকাতে যেখানে-সেখানে হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও অফিস স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এতে করে রাজউকের কতিপয় সিন্ডিকেট লাভবান হলেও নগরীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে এসব এলাকায়। শুধু হোটেল-রেস্টুরেন্ট নয় কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক এলাকার ভিতরে। যাচাই-বাছাই না করেই বিভিন্ন রকমের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়ায় আবাসিক এলাকা তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে পরিণত হচ্ছে বাণিজ্যিক এলাকায়। নগরবিদ মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ১৫ বছর আগে ধানমন্ডি এলাকায় চারতলার উপরে কোনো বাড়ি ছিল না। এখন ইচ্ছামতো উচ্চতায় দালানকোঠা তৈরি চলছে। ভাড়া দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে। ধানমন্ডি থেকেই এই বাণিজ্যিকীকরণের ভাইরাস নগরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, আস্তে আস্তে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। গুলশান-বনানী এলাকার নকশাতে বাণিজ্যিক প্রয়োজনের জন্য আলাদাভাবে নকশা করা আছে। অথচ রাজউক এই পুরো বিষয়টি গোপন করে গুলশানের একটি রোডকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। এরপর আস্তে আস্তে ঘিঞ্জিতে পরিণত হতে থাকে পরিকল্পিত নকশায় গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকা গুলশান-বনানী। একে একে আবাসিক এলাকাগুলো হারিয়ে ফেলছে তার চরিত্র। আর এজন্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের। সরেজমিন এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আবাসিক বাড়িঘরের সঙ্গে শুধু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠেনি, সেখানে পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে শিল্প-কারখানা। রাজউকের কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের তদারকির মধ্যেই আবাসিক ভবনের মাথার ওপর একের পর এক তরতর করে উঠছে শপিং সেন্টার। এখন অভিজাত এলাকাসমূহে কোনটা আবাসিক আর কোনটা বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা তা বুঝে ওঠা কঠিন। ধানমন্ডির গ্রিন রোডসহ আশপাশ এলাকা এমনই ঘন ঘিঞ্জি বাণিজ্যিক স্থাপনার হাটবাজারে পরিণত হয়েছে। আবাসিক ভবনের নিচতলা ব্যবহৃত হচ্ছে কারখানা কিংবা ওয়ার্কশপ হিসেবে। দোতলা, তিনতলা ও চারতলাকে বানানো হয়েছে মার্কেট। এরও ওপরের তলাসমূহ ব্যবহৃত হচ্ছে আবাসিক ফ্ল্যাট হিসেবে। সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। অভিজাত এলাকা খ্যাত গুলশান-বনানীর অবস্থা আরও নাজুক। অর্ধশতাধিক স্কুল ও কলেজ, অন্তত দেড় ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় ২০টি ব্যাংক, শপিং মল, কমিউনিটি সেন্টার, শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রয়েছে গুলশানে। এ ছাড়া চায়নিজ ও ফাস্টফুডের দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ বিভিন্ন ধরনের দোকানপাটও রয়েছে। সেখানে যাবতীয় বাণিজ্যের ধকল সহ্য করেই বসবাস করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। অবিরাম হৈচৈ, রাস্তাজুড়ে পার্কিং, গভীর রাত পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের আনাগোনা মিলিয়ে বিশ্রী বেহাল অবস্থা চলছে গুলশান-বনানীজুড়ে। জানা গেছে, বিভিন্ন সময় রাজউক থেকে আবাসিক ভবন নির্মাণের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা অনাবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করে আসছেন। বরাদ্দের চুক্তিপত্র লঙ্ঘন করে আবাসিক প্লটে কেউ কেউ শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন। আর এসব অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করে লাভবান হচ্ছেন রাজউকের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। অভিজাত গুলশান-বনানী থেকে উত্তরা মডেল টাউন পর্যন্ত আবাসিক এলাকার চেহারা মাত্র কয়েক বছরেই আমূল বদলে গেছে। অলিগলির শত শত বাসাবাড়িতেও গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কয়েকটি ব্র্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বিলাসবহুল পণ্যের দোকান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দোকান-মালিক বলেন, বাসাবাড়িতে দোকান দিলে ভাড়া তুলনামূলক কম পড়ে। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিলসহ অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই আবাসিক বিল পরিশোধ করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা শিল্প-কারখানা চালানো সম্ভব হয়। অন্যদিকে ভবন মালিকদের বক্তব্য হচ্ছে, বাসাবাড়ি বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিলে বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। এ প্রক্রিয়ায় উত্তরার ৩, ৬, ৭ ও ৫ নম্বর সেক্টরের প্রায় প্রতিটি সড়কের বাসাবাড়িতে দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এর আগে সংসদীয় উপকমিটি শুধু গুলশান-বনানী-বারিধারাতেই অবৈধভাবে ব্যবহৃত ৫০০ প্লটের সন্ধান পায়। এর মধ্যে গুলশানে রয়েছে ৪৮৬টি ও নিকুঞ্জে ১৪টি প্লট। এ ছাড়া নিকুঞ্জ ১ ও ২ তে প্রায় ৫১২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে।

রাজধানীতে আইন অমান্য করে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা। আবাসিক এলাকায় এসব কারখানা গড়ে উঠলেও দেখার কেউ নেই। নাগরিকদের জন্য এসব কারখানা শুধু বিড়ম্বনারই নয়, রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবেশবিদদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব অবৈধ কারখানার ভবন যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়াসহ কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অগ্নিকাণ্ডের মতো বিভিন্ন দুর্ঘটনার। সেই সঙ্গে শব্দসহ নানা ধরনের দূষণ ঘটাচ্ছে ওই সব কারখানা। এ ব্যাপারে স্থপতি মো. ফয়েজউল্লাহ বলেন, গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডির মতো পরিকল্পিত এলাকাতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এতে করে এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদাভাবে চেষ্টা করতে হবে। নতুনভাবে আরও আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার পাশাপাশি এসব এলাকার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।

সর্বশেষ খবর