শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা

ফয়জুরকে সিলেটে ভাইকে ঢাকায় জিজ্ঞাসাবাদ

মাহবুব মমতাজী ও শাহ্ দিদার আলম নবেল

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্ত ফয়জুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি)। তার কাছ থেকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার তথ্য উদ্ঘাটনের নানা চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে পুলিশের হেফাজতে থাকা তার ভাই এনামুল হাসানকেও ঢাকায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সহায়তায় গজীপুর থেকে এনামুলকে গ্রেফতার করা হয়। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনামুলকে সিলেট পুলিশের কাছে আজ হস্তান্তর করা হবে বলে জানা গেছে। হামলার  ঘটনার পর আটক ফয়জুরের বাবা ও মাকে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে, নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে— সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত হবে একই দিনে। 

সিটিটিসির উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহিবুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনাটি তদন্ত করছে এসএমপি। তাদের ওখানকার দায়ের করা মামলায় তারা আমাদের সহায়তায় ফয়জুরকে গ্রেফতার করে। গত বৃহস্পতিবার ফয়জুরকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ওইদিন থেকেই শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। সংশ্লিষ্টরা জানান, রিমান্ডে ফয়জুরের কাছ থেকে তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। ফয়জুর কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য কিনা, জাফর ইকবালের ওপর হামলার পেছনে তার সঙ্গে আর কারা ছিল, সিলেটে কোনো জঙ্গির সঙ্গে ফয়জুরের যোগাযোগ ছিল কিনা—এসব তথ্য জানতে চান জিজ্ঞাসাবাদকারীরা। জনা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ফয়জুর জানায়, তার ব্যবহৃত সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস তার ভাই এনামুলের কাছে আছে। এর প্রেক্ষিতে পুলিশ এনামুলকে গ্রেফতার করে। পুলিশের ধারণা, জাফর ইকবালের ওপর হামলার পরপরই এনামুল ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। এনামুলকে গ্রেফতারের সময় একটি মোবাইল সেট, একটি ট্যাব ও মেমোরি কার্ড জব্দ করা হয়। ফয়জুরের ব্যবহৃত ট্যাবের মাধ্যমেই সে যোগাযোগের সিক্রেট অ্যাপস টেলিগ্রাম এবং দাওয়া ইলাল্লাহ ফোরামে যুক্ত ছিল। আর সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে সিটিটিসি সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পরই ঢাকায় এনামুলকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ফয়জুরের ব্যবহৃত ডিভাইস ও গেঞ্জি নিজের কাছে হেফাজতে রাখার তথ্য জানিয়েছে এনামুল। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সিলেট নগরীর জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, ফয়জুরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য জানা গেছে। আরও তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। এদিকে পুলিশি নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর নিরাপত্তা বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ নিয়ে খুব শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আলোচনায় বসবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এরই মধ্যে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের পরিবারের নিরাপত্তা ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) নামে মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয় ড. জাফর ইকবাল এবং তার স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হককে। দুটি মোবাইল নম্বরে আলাদাভাবে এসএমএস পাঠানো হয়। ১৪ অক্টোবর এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তারা। এরপর থেকেই তাদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। জাফর ইকবাল দম্পতির বাসভবনসহ সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সব সময় ৩৪ জন পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। এরপরও ৩ জানুয়ারি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই বহিরাগত যুবক হামলা চালায় ড. জাফর ইকবালের ওপর।  তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে নেওয়ার পর ফয়জুর জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে— ইসলামের শত্রু জাফর ইকবালের ওপর হামলা করার জন্য দাওয়া ইলাল্লাহ নামে একটি উগ্রবাদী ফোরামের নিয়মিত আলোচনাও হতো। দাওয়া ইলাল্লাহ নামে ফোরামের নির্দেশনায়ই জাফর ইকবালের ওপর হামলা করার জন্য সিলেটের মদিনা মার্কেটের একটি জিমে শারীরিক প্রশিক্ষণের জন্যও ভর্তি হয়। জাফর ইকবালের ওপর কীভাবে হামলা করতে হবে এবং কোথায় আঘাত করলে দ্রুত মৃত্যু হতে পারে দাওয়া ইলাল্লাহ ফোরামে সেসব কৌশল নিয়েও আলোচনা করা হয়েছিল। দাওয়া ইলাল্লাহ হলো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং আনসার আল ইসলামের একটি অনলাইন ফোরাম। যেখানে নির্দিষ্ট আইডির মাধ্যমেই কেবল প্রবেশ করা যায়। বিভিন্নভাবে পরীক্ষিত লোকজনই এই ফোরামের আলোচনায় যুক্ত হতে পারে। জাফর ইকবালের ওপর হামলার চূড়ান্ত নির্দেশনা পাওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী সিলেটের জিন্দাবাজারের আল-হামরা মার্কেটের একটি দোকান থেকে কমান্ডো নাইফটি (চাকু) কেনে ফয়জুল হাসান ওরফে ফয়জুর। ফয়জুরকে জিজ্ঞাসাবাদে এ পর্যন্ত ধারণা পাওয়া গেছে যে- তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল। কিন্তু সে তা নিয়ে মুখ খুলতে চাইছে না।

তার সহযোগীদের শনাক্ত করাসহ গ্রেফতারের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফয়জুরের ব্যবহৃত একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধারের পর ঘেঁটে দেখেছেন। সেখানে আল-কায়েদা এবং আইএসের নানারকম ভিডিও, ইরাক-সিরিয়ার ভিডিওসহ নানারকম জঙ্গিবাদী প্রপাগাণ্ডা প্রচারণার উপাদান পাওয়া গেছে। তবে এসব উপাদান অন্য জায়গা থেকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফয়জুর ট্যাবের মাধ্যমে এসব কিছু ডাউনলোড এবং সব যোগাযোগ স্থাপন করত বলে তদন্তকারীদের দাবি।

হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন : কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল কিশোরগঞ্জের ভৈরবে প্রতিবাদসভা ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। শিশু সংঘটন কাকলি খেলাঘর আসর ও সাংস্কৃতিক সংঘটন নিবেদিতা নাট্যঙ্গন যৌথভাবে স্থানীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এ কর্মসূচি পালন করে। নোয়াখালী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ব্যাঞ্জনা খেলাঘর শাখার আয়োজনে বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল সকালে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বসুরহাট জিরো পয়েন্টে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর