সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্যাম্পের বাইরে ঠিকানা গড়তে মরিয়া রোহিঙ্গারা

কাবিন ছাড়াই বিয়ে করছে বাঙালিদের, শিশুদের শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হচ্ছে বাসাবাড়িতে

ফারুক তাহের, কক্সবাজার থেকে

ক্যাম্পের বাইরে ঠিকানা গড়তে মরিয়া রোহিঙ্গারা

অবৈধ কৌশলে ক্যাম্পের বাইরে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্থায়ী ঠিকানা গড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা। শহরে ও গ্রামের বাসাবাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুদের। এ ছাড়া স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ার লোভে রোহিঙ্গা তরুণীরা কাবিন ছাড়াই বিয়ে করছে বাঙালিদের। যেভাবেই হোক ক্যাম্পের ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরের বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য বিয়েকেই বেছে নিচ্ছে রোহিঙ্গা তরুণীরা। বাঙালিদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিয়ে অবৈধ হলেও এখানে একটি স্থায়ী আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে চায় রোহিঙ্গারা। তাই আইনগত ভিত্তি না থাকলেও বিয়ের মতো একটি সামাজিক দৃঢ় বন্ধনে অবৈধভাবে আবদ্ধ হচ্ছে কতিপয় বাঙালি ও রোহিঙ্গা। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে কক্সবাজার অঞ্চলের সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন। কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের এপিপি সাকিয়া-এ কাউসার সাকী জানান, বাঙালি-রোহিঙ্গাদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। সম্প্রতি আগত রোহিঙ্গা তরুণীরা অনেকেই গোপনে বিয়ে করেছে। কাবিন হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় এর প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ পাচ্ছে না। তবে এটা ভয়াবহ রূপ লাভ করবে, যদি বন্ধ করা না যায়। স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ২৫ আগস্টের আগে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই ইতিমধ্যে বিবাহ সূত্রে জাতীয় সনদপত্র তৈরি করেছে। এই সনদ দিয়ে পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্টও করেছে নিজের নামে। কিন্তু এদের জন্ম মিয়ানমারে হলেও এখন এখানকার নাগরিক হিসেবে বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। বিষয়গুলো নানা জটিলতার জন্ম দিচ্ছে বলে জানান উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আসার কারণে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। মানবিকতা দেখানো ছাড়া এতে আর কোনো একটি লাভ হয়েছে বলে কেউ বলতে পারবে না।’ এদিকে বিবাহের কাবিন না থাকায় রোহিঙ্গা মহিলারা পারিবারিক আইনে মামলা না করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করে আসছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে এ রকম অসংখ্য মামলা রয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের করা। কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলা করতে আসা চকরিয়ার খুটাখালীর গৃহবধূ শামসুন নাহার বলেন, ‘স্থানীয় কবির আহমদের সঙ্গে তিন বছর আগে আমার বিয়ে হয়। আমাদের সংসারে দুই ছেলে রয়েছে। আমাদের সুখের সংসারে অশান্তির আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এক রোহিঙ্গা তরুণী। বিলকিছ আকতার নামের ওই রোহিঙ্গা তরুণীকে অবৈধভাবে বিয়ে করে আমার স্বামী পাহাড়ের কিনারায় নতুন ঘর বেঁধে দিয়েছে। স্বামী বর্তমানে ওই বাড়িতে থেকে মাঝে-মধ্যে আমার বাড়িতে এসে আমাকে নির্যাতন করে। কয়েক মাস ধরে আমাদের কোনো খরচপাতি না দেওয়ায় দুই শিশুকে নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছি। তাই মামলা করতে আদালতে এসেছি। আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে মামলার করেছি।’

অন্যদিকে স্বামীর হাতে নির্যাতিতা রোহিঙ্গা নারী শাকেরা বেগম বলেন, ‘বিসিক এলাকার মো. সৈয়দের সঙ্গে এক বছর আগে আমার বিয়ে হয়। কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলিতে একটি ভাড়া বাসায় আমাকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন সৈয়দ। সম্প্রতি আমি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে আমার স্বামী আর বাসায় আসছেন না। পরে বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলে তার প্রথম স্ত্রী আমাকে নির্যাতন করে আহত করেন। বিয়ের কোনো কাগজ ও জাতীয়তা সনদ না থাকায় মামলাও করা যাবে না বলে জানিয়েছেন এক আইনজীবী।’

এদিকে অনেকেই কাজের লোক হিসেবে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুদের। বাড়িতে কাজের জন্য স্থানীয় কোনো নারী বা শিশুকে পাওয়া যায় না। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দালালদের মাধ্যমে শিশুদের ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। অনেক সময় এতে তাদের বাবা-মার সম্মতিও থাকে। এ ব্যাপারে উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) এম কায়কাউস বলেন, প্রশাসনের কড়া নজরদারি থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের কার্যকলাপ হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের যেমন বিয়ে করা যাবে না, তেমনি তাদের কাছে কাউকে বিয়েও দেওয়া যাবে না। এ ধরনের সরকারি ঘোষণা থাকার পরও কিছু ঘটনা ঘটছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা নারী বিয়ে করার কারণে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর পরও থামছে না। তাই আরও সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার সিটি সোসাইটির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘স্থানীয় নারীরা সহজে বিবাহিত লোককে বিয়ে করতে চায় না। করলেও কাবিন ছাড়া করে না। কিন্তু রোহিঙ্গা তরুণীরা স্থায়ী হতে যেভাবেই হোক বিয়ের প্রস্তাব দিলে রাজি হয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের সমাজের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর