মঙ্গলবার, ১৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

জামিন পেলেও মুক্ত হচ্ছেন না খালেদা

কুমিল্লার এক মামলায় গ্রেফতার দেখানোর নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কুমিল্লা প্রতিনিধি

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাভোগী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাই কোর্ট চার মাসের জামিন দিলেও এখনই মুক্তি পাচ্ছেন না তিনি। গতকাল বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়াকে চার যুক্তিতে জামিন দেয়। অন্যদিকে গাড়িতে পেট্রলবোমা মেরে আটজনকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর নির্দেশ দিয়ে ২৮ মার্চ খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছে কুমিল্লার একটি আদালত। আদেশের পর দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘হাই কোর্ট যে যুক্তিতে জামিন দিয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করব।’ অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘জামিন স্থগিত চেয়ে আমরা আপিল করব। এ বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকেও জানিয়ে দেওয়া হবে।’ আদেশের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জানান, জামিন পেলেও মুক্তির বিষয়ে নানা প্রক্রিয়া শেষ হতে কিছু সময় লাগতে পারে। ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ আরও পাঁচজনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান। ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান রায় দেওয়ার ১০ দিন পর সত্যায়িত অনুলিপি পেয়ে হাই কোর্টে আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। একই সঙ্গে তিনি জামিনের আবেদনও জানান। এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট খালেদা জিয়ার জরিমানা স্থগিত করে বিচারিক আদালতের নথি (এলসিআর) তলব করে। পরে ২৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি নিয়ে এলসিআর আসার পর আদেশ দেওয়া হবে বলে জানায় হাই কোর্ট। সে অনুযায়ী খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের আবেদনে বিষয়টি রবিবার আদেশের জন্য কার্যতালিকায় রাখা হয়েছিল। তবে ওইদিন বিচারিক আদালতের নথি না আসায় আদেশের জন্য সোমবার (গতকাল) বেলা ২টায় সময় নির্ধারণ করে হাই কোর্ট। এরপর রবিবার বিকালে বিচারিক আদালতের নথি পৌঁছায় হাই কোর্টে। গতকাল বেলা ২টা ১৫ মিনিটে বেঞ্চের দুই বিচারপতি এজলাসে ওঠেন। শুরুতেই খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের কাছে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম জানতে চান, তাদের কিছু বলার আছে কি না। তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘জামিন আবেদনের শুনানি তো শেষ হয়েছে। আমরা আদেশের জন্য অপেক্ষা করছি। যদি রাষ্ট্রপক্ষ কিছু বলে তাহলে আমরা জবাব দেব।’ এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এ মামলাটি স্পর্শকাতর। বিচারিক আদালত খালেদা জিয়ার বয়স ও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনা করে তাকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে। যেহেতু নিম্ন আদালতের নথি এসেছে, সেহেতু আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দিন।’ তিনি বলেন, ‘এটি একটি দুর্নীতির মামলা। এখানে এতিমের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে।’ সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের মামলার নজির তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তিনি (এরশাদ) সাড়ে তিন বছর কারাগারে ছিলেন। খালেদা জিয়া মাত্র এক মাস কারাগারে আছেন। অতএব তাকে জামিন দেওয়া ঠিক হবে না।’ এ সময় আদালত বলে, ‘তখন তার (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) বয়স কত ছিল।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তখন বয়স ছিল ৬৫ বছর।’ আদালত বলে, ‘তিনি (এরশাদ) তো ওই সময় শারীরিকভাবে ফিট ছিলেন। তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে বিয়ে করেছেন। আল্লাহর রহমতে পুত্রসন্তান লাভ করেছেন।’ এ সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘সাজার পরিমাণ কম এ বিবেচনায় জামিন দেওয়া উচিত হবে না। এটা জামিন দেওয়ার গ্রাউন্ড হতে পারে না। তিনি (খালেদা) তার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়ে কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখাননি।’ এ সময় আদালত বলেন, ‘এ শুনানি তো আপনি আগেও করেছেন। নতুন কী আছে সেটা বলুন।’ এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আগে তিনি (খালেদা জিয়া) অসুস্থ ছিলেন। এই অসুস্থতার কারণে হাঁটাচলা করতে পারেননি।’ এ জে মোহাম্মদ আলী এ সময় একটি দুর্নীতির মামলায় সাত বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাই কোর্টের একক বেঞ্চে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। পরে আদালত চারটি গ্রাউন্ড তুলে ধরে খালেদা জিয়াকে চার মাসের অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করে। আদেশের সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহম্মেদ ও এ কে এম আমিন উদ্দিন এবং দুদকের পক্ষে খুরশীদ আলম খান উপস্থিত ছিলন। খালেদা জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী ও জয়নুল আবেদীন ছাড়াও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

চার যুক্তিতে খালেদার জামিন : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চার যুক্তিতে জামিন দিয়েছেন হাই কোর্ট। এর মধ্যে প্রথমত, নিম্ন আদালত পাঁচ বছরের যে সাজা দিয়েছে, তুলনামূলকভাবে কম ওই সাজায় হাই কোর্টে জামিনের রেওয়াজ আছে। দ্বিতীয়ত, বিচারিক আদালতের নথি এসেছে, কিন্তু শুনানির জন্য আপিল এখনো প্রস্তুত হয়নি। ফলে আসামি জামিনের সুবিধা পেতে পারেন। তৃতীয়ত, বিচারিক আদালতে মামলা চলাকালে খালেদা জিয়া জামিনে ছিলেন এবং এর অপব্যবহার করেননি। আদালতে নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন। চতুর্থত, বয়স ও বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় নিয়ে তাকে জামিন দেওয়া যায়।

ড. কামালের বিবৃতি : খালেদা জিয়ার জামিনের পর এক বিবৃতিতে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জামিন মঞ্জুর হয়েছে হাই কোর্টে। এ ধরনের মামলায় এটা নিয়মিত হওয়া দরকার ছিল। আইনের শাসনে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ করে থাকে স্বাধীন বিচার বিভাগ। স্বাধীন বিচার বিভাগের গুরুত্ব প্রত্যেককে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে।

কুমিল্লায় গ্রেফতার দেখানোর নির্দেশ : কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলায় আট যাত্রী হত্যা মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার দেখানোর নির্দেশসহ মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখে তাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ (পিডব্লিউ) দিয়েছে কুমিল্লার একটি আদালত। গতকাল কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মুস্তাইন বিল্লাহ এ আদেশ দেন। মামলার পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮ মার্চ দিন ধার্য করেন বিচারক। কুমিল্লার কোর্ট ইন্সপেক্টর সুব্রত ব্যানার্জি এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। আদালত সূত্র জানায়, গতকাল কুমিল্লার ৫ নম্বর আমলি আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুস্তাইন বিল্লাহর আদালতে গুলশান থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদনের পর বিকালে এ আদেশ দেওয়া হয়। এর আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম জয়নব বেগম বাসে পেট্রলবোমা হামলায় আটজন হত্যা মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে ২০-দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুরে একটি বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে আট যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান বাদী হয়ে ৭৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ছয় নেতাকে হুকুমের আসামি করা হয়।

এবার ১৯ মার্চ সোহরাওয়ার্দীতে জনসভা করতে চায় বিএনপি : কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে এবার ১৯ মার্চ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া আগামী ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম, ২৪ মার্চ বরিশাল এবং ৩১ মার্চ রাজশাহীতে জনসভা করবে বিএনপি। গতকাল সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আজকে আমাদের জনসভার অনুমতি না  দেওয়ায় আমরা তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানাই। জনসভা করতে না দেওয়ার জন্য আমরা কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি দেব না। আমরা ব্যতিক্রম কর্মসূচি দিচ্ছি। আমরা আগামী ১৯ মার্চ পুনরায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষণা করছি। আমি আশা করছি, যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সভার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আর আমরা আশা করছি, সরকার সমাবেশ করতে আমাদের সহযোগিতা করবে।’

সর্বশেষ খবর