বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রোকসানা ফারিয়া তামান্নার পর চলে গেলেন পৃথুলাও

জিন্নাতুন নূর

রোকসানা ফারিয়া তামান্নার পর চলে গেলেন পৃথুলাও

রোকসানা, ফারিয়া, তামান্নার পর না-ফেরার দেশে চলে গেলেন দেশের আরেক সম্ভাবনাময় নারী পাইলট  পৃথুলাও। পাইলট হিসেবে পাখির মতো আকাশে ডানা মেলে বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা ছিল পৃথুলারও। কিন্তু বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর দুই বছরের মধ্যেই তাকেও তার অগ্রজ তিন নারী বৈমানিকের মতো না-ফেরার পথে পা বাড়াতে হলো। দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে বিমান চালনার অনুমতি পান ক্যাপ্টেন সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। তিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী পাইলট। ’৮৪ সালের ৫ আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন রোকসানা। আর পৃথুলা রশীদ ২০১৬ সালে পাইলট হিসেবে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসে যোগ দেন। গত ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কো-পাইলট হিসেবে অবতরণ করতে গিয়ে নিজেকে না বাঁচিয়ে যাত্রীদের বাঁচিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বেসরকারি বিমান এয়ারলাইনস ইউএস-বাংলার একমাত্র নারী বৈমানিক ছিলেন পৃথুলা রশীদ। গত চার দশকের বেশি সময়ে দেশের ইতিহাসে এ দুই নারী পাইলট ছাড়া আরও দুই নারী পাইলট বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তারা হলেন দেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক পাইলট ফারিয়া হোসেন লারা ও প্রথম সামরিক নারী পাইলট তামান্না রহমান হৃদি। বাংলাদেশের প্রথম নারী বৈমানিক হিসেবে ১৯৭৭ সালে বিমান চালনার অনুমতি পান ক্যাপ্টেন সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা। সরকারি বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রথম নারী পাইলট তিনি। খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণের জন্য ’৮৪ সালের ৫ আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন রোকসানা, যা ছিল দেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনা। আর এটি ছিল বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফকার এফ২৭-৬০০ বিমান। এতে মোট ৪৯ জন নিহত হন। এই বিমানে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে বর্তমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পূর্বনির্ধারিত যাত্রী পরিবহন করার কথা ছিল। বিমানটিতে বাণিজ্যিক চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন রোকসানা। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে এটি জলাভূমির মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দুর্ঘটনার দিন ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে দৃষ্টিসীমা সীমিত ছিল। এ অবস্থার মধ্যে বিমানের পাইলট রোকসানা বেতার যোগাযোগের মাধ্যমে অবতরণ করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথমে ৩২ নম্বর রানওয়েতে অবতরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু রানওয়ে দেখা না যাওয়ায় শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারেন যে তিনি ভুল দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এজন্য দ্বিতীয়বার আইএলএস ব্যবহার করে অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে রানওয়ে ১৪-তে অবতরণ করার নির্দেশনা নেওয়া হয়। এরপর ভারি বৃষ্টির মধ্যে প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় অবতরণের চেষ্টা করলে বাতাসের ঝাপটায় আবার ব্যর্থ হন রোকসানা। আর তৃতীয়বার অবতরণের চেষ্টা করার সময় বিমানটি রানওয়ে থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে একটি ডোবায় অবতরণ করে এবং বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানটির ৪ ক্রু ও ৪৫ যাত্রীর সবাই নিহত হন।

দেশে বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যুবরণ করেন যে দ্বিতীয় নারী পাইলট তার নাম ফারিয়া হোসেন লারা। তিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক পাইলট। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণ উড্ডয়নের সময় দুর্ঘটনায় পড়ে নিহত হন এই বৈমানিক। এয়ার পারাবাতের একটি বিমানে আগুন লেগে ফারিয়াকে বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ঢাকার পোস্তগোলায় বিমানটি বিধ্বস্ত হলে নিহত হন ফারিয়া। বিধ্বস্ত বিমানটি ছিল সেসনা-১৫০ প্রকৃতির। ১৯৭০ সালের ১৬ এপ্রিল ফারিয়া লারা ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কন্যা। ১৯৯২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাস করে ফারিয়া পাইলট হওয়ার জন্য পাইলট প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। ’৯৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন। আর ’৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রাইভেট পাইলটের লাইন্সেস অর্জন করেন। ’৯৮ সালের ১৯ মার্চ ফারিয়া বাণিজ্যিক পাইলট হিসেবে লাইসেন্স লাভ করেন। এর পরই তিনি পাইলটদের প্রশিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ৫০ ঘণ্টার এই প্রশিক্ষণের শেষ দিনটিতে, অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর, ’৯৮ সালে বিমান দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন ফারিয়া। বিমান থেকে পাঠানো জরুরি বার্তায় শেষবারের মতো তিনি বলেন, ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমি হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ বিমান দুর্ঘটনায় পড়ার কিছুক্ষণ আগে এই বার্তা নিয়ন্ত্রণকক্ষকে দিয়েছিলেন ফারিয়া। দেশের ইতিহাসে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত তৃতীয় নারী পাইলটের নাম তামান্না রহমান হৃদি। প্রশিক্ষণার্থী এই নারী পাইলটের বাবা পেশায় চিকিৎসক হওয়ায় স্বপ্ন ছিল মেয়েও তার মতো চিকিৎসক হবেন। কিন্তু টাঙ্গাইলের মেয়ে তামান্না চেয়েছিলেন বিমানের পাইলট হতে। এজন্য ভর্তি হন বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে। গ্রাউন্ড প্রশিক্ষণ শেষে ফ্লাইং প্রশিক্ষণও শুরু করেন তামান্না। কিন্তু পাইলট ব্যাচ পরার পরই তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে। যদিও এই পাইলট যশোরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ঘাঁটিতে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর সফলতার সঙ্গে শেষ করেছিলেন ‘সলো টেস্ট’। সে সময় তিনি প্রথম সামরিক পাইলট হিসেবেও স্বীকৃতি পান। প্রশিক্ষণ নিতে তামান্না রাজশাহীতে পার্সোনাল পাইলট লাইসেন্স (পিপিএল) কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। সর্বশেষ ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় নিহত হন বৈমানিক পৃথুলা রশীদ। এই বৈমানিক ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে পৃথুলার প্রোফাইল পিকচার ও নিজের সম্পর্কে দেওয়া তথ্যে পেশার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। বৈমানিকের সাদা পোশাক পরা পৃথুলা নিজের সম্পর্কে ইংরেজিতে লিখেছেন, ‘অরডিনারি গার্ল উইথ এক্সট্রা অরডিনারি লাভ ফর এভিয়েশন, লিটারেচার অ্যান্ড ফ্লুফি অ্যানিমল্স।’ বিমান দুর্ঘটনার সময় পৃথুলা সহকারী পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও নিজের জীবনের বিনিময়ে বীর এই নারী পাইলট বাঁচিয়ে যান ১০ নেপালি যাত্রীর প্রাণ। এজন্য নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল সাইটে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ বলে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। নেপালি যাত্রীদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদে সরিয়ে দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তিনি। এরপর নিজে মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হন। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে এই বৈমানিক ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসে চাকরি করছিলেন। আর বিমান চালনার জন্য তিনি আরিরাং নামের একটি এভিয়েশন প্রতিষ্ঠান থেকে উড্ডয়নের ডিগ্রি নেন।

সর্বশেষ খবর