রবিবার, ১৮ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

মৃত্যুভয় প্রতি নিশ্বাসে

মির্জা মেহেদী তমাল

মৃত্যুভয় প্রতি নিশ্বাসে

‘পাহাড়ি পথ। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। ঘন জঙ্গল। সূর্যের আলো ঠিকমতো মাটিতে পড়ে না। সে রকম পথ ধরে ছুটছি। ছোট ছোট পাহাড়, আবার কখনো বড় পাহাড়। পাড়ি দিচ্ছেন আমার মতো আরও অনেকেই। একজনের পেছনে আরেকজন— লম্বালম্বিভাবে দৌড়াচ্ছি।’

‘পেছন থেকে আমাদের কুকুরের মতো তাড়া করছিল বন্দুক আর লাঠি হাতে কয়েকজন। আমাদের চলার গতি কমলেই আর কথা নেই। বন্দুকের বাঁট বা মোটা লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত। আঘাতে কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। আবার উঠেই দৌড়াচ্ছে। তাদের দেখানো পথে তাই প্রাণপণ আমাদের ছুটে চলা। এক দিন নয়, এমনভাবে ছুটেছি পরপর ছয় দিন। একসময় আমাদের থামতে বলা হলো। তারা জানাল, আমরা আমাদের জায়গায় নাকি পৌঁছে গেছি। কিন্তু সে রকম কিছু দেখছি না। বনের ভিতর থেকে আমাদের বের করছে না। তবে কোথায় এলাম? আমাদের ধাক্কাতে ধাক্কাতে একটি গুহার ভিতর নিয়ে গেল। অন্ধকার। কিছু সময় আমাদের বিশ্রামের সুযোগ দিল। কেউ কেউ পেটের ক্ষুধায় কাঁদছে। কেউ হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। কেউ জ্ঞান হারিয়েছে। বন্দুকধারীরা আমাদের কাছে টাকা দাবি করতে থাকে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তো কোনো টাকা নেই। তারা মোবাইল নাম্বার চায়। আমরা দিলাম। কিন্তু অনেকের আত্মীয়স্বজনকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় না। এবার তারা ক্ষুব্ধ হয়। আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অমানুষিক নির্যাতন করতে থাকে। আমরা সবাই গগনবিদারী চিৎকার করি। কিন্তু আমাদের সেই চিৎকার গুহার ভিতরেই আটকে থাকে। তাদের নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে ধাকে। যাদের আত্মীয়স্বজনকে ফোনে পাওয়া যায় বা টাকাপয়সা নিয়ে কথাবার্তা পাকা হয়, তাদের আলাদা করে রাখা হয়। আমরা যারা টাকার সংগ্রহ করতে পারছিলাম না, তাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চলতে থাকে। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। গলগল করে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। নোনতা স্বাদ পাচ্ছিলাম। নির্যাতনকারীদের টর্চের আলোয় হঠাৎ দেখতে পাই, ভিতরের দিকে একপাশে পড়ে আছে কয়েকটি রক্তাক্ত লাশ। একটার ওপর আরেকটা। মারধর আর গগনবিদারী চিৎকারে সেখানে তখন বিভীষিকাময় পরিবেশ। আমাদের সামনে যেন যমদূত সব দাঁড়ানো। আমি নিশ্চিত, আমার মৃত্যু হচ্ছে যখন-তখন। মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বড় ভাই যখন আমাকে ট্রলারে উঠিয়ে দেন, বার বার বলছিলাম— বিদেশে গিয়েই ফোন দেব। তোমরা চিন্তা করো না। ভাই আমার শুধু হাত তুলে থাকেন। কথা বলতে পারছিলেন না। আমি জানি, তখন ভাই আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। সেসব কথা মনে পড়ছে বার বার। আর ফেরা হবে না বাড়িতে। জঙ্গলেই লাশ পচে-গলে যাবে। শিয়াল-কুকুরে খাবে আমার এই হাত-পা, শরীর। টাকা টাকা বলে ওরা চিৎকার করছিল, আর হায়েনার মতো আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। শরীরে একটা প্রচণ্ড আঘাত পাই। পুরো শরীর কেমন যেন গুলিয়ে যায়।’ ‘চোখ খুলতে পারছিলাম না। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। কেমন যেন গন্ধ লাগছিল নাকে। কী মনে করে ভালো করে চোখ খুলি। আরে, এ কী! আমি তো পড়ে আছি লাশের ওপর! আগের কথা মনে করার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, মনে পড়ে। টাকার জন্য নির্যাতন করা হচ্ছিল আমাদের। পরে বুঝতে পারি, ওরা আমাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায় লাশের স্তূপের ওপর।’ ২০ বছরের তরুণ সাহাবুদ্দিন। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার ট্রানজিট থাইল্যান্ড জঙ্গলে নির্যাতনের কথা বর্ণনা করছিলেন। বলছিলেন তার সমুদ্রযাত্রায় ঘটে যাওয়া সব শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী। তিনি যখন তার সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথাগুলো বর্ণনা করছিলেন, চোখে-মুখে তখন আতঙ্কের ছাপ। একপর্যায়ে হু হু করে কাঁদতে থাকেন সাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘কেউ যেন আর এ পথে বিদেশে যাওয়ার কল্পনাও না করেন।’ তবে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করেন। কারণ ট্রলারে তার সামনেই মারা গেছেন ১৩ জন। সেখানে ছিলেন তার এক বন্ধুও। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রতি নিঃশ্বাসেই ছিল আমার মৃত্যুভয়।’ কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং এলাকার সোনাইছড়ি গ্রামের নুরুল ইসলামের সন্তান এই সাহাবুদ্দিন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এই সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় উখিয়ার সোনাইছড়ায়। কথা হয় তার ভাই আনোয়ারের সঙ্গেও। তিনি জানান, তার ছোট ভাইকে মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আনা হয়েছে অসুস্থ অবস্থায়। দেশে আনার পর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু তিনি এখনো সুস্থ হননি। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শারীরিকভাবে এখনো সুস্থ নন। কোনো কাজকর্ম আর করতে পারছেন না। শারীরিকভাবে তিনি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার জীবনটাই এখন অনিশ্চিত। স্থানীয় পাচারকারী চক্রের দালাল জনি নানা প্রলোভন দেখান সাহাবুদ্দিনকে। জনি বলেছিলেন, বিদেশ যেতে নগদ কোনো টাকা লাগবে না। মালয়েশিয়া পৌঁছে দেড় লাখ টাকা দিলেই চলবে। জাহাজে টেলিভিশন দেখতে দেখতে মালয়েশিয়া পৌঁছে যাওয়া যাবে। জনির এমন প্রস্তাবে সাহাবুদ্দিন ছিলেন রাজি। বাবা-মাকেও রাজি করাতে হয় নানাভাবে। সাহাবুদ্দিন মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সাহাবুদ্দিন জানান, উখিয়ার সোনাইছড়া সমুদ্র পয়েন্ট থেকে একই গ্রামের মোট ৩০ জন একটি ট্রলারে ওঠেন। দুই দিন তারা সাগরেই ভাসেন। বহুদূর যাওয়ার পর তাদের তোলা হয় জাহাজের মতো একটি বড় ট্রলারে। ওই ট্রলারে ছিলেন আরও ৬০০ যাত্রী। সবাই মালয়েশিয়া যাবেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সেখানে মিয়ানমারের নাগরিকও ছিলেন। তবে ছোট ট্রলারে করে রওনা দেওয়ার সময় বাংলাদেশি দালাল থাকলেও বড় ট্রলারে তারা ছিলেন না। সেখানে ছিলেন সব থাইল্যান্ডের নাগরিক।

সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘যাত্রা হয় আমাদের। এক দিন যায়, দুই দিন যায়, সপ্তাহ পার হয়। কিন্তু দিগ্বিদিক কিছুই বুঝতে পারি না। একসময় জানতে পারি, আমাদের ট্রলার নাকি দিক হারিয়েছে। যে পরিমাণ খাবার ছিল, তাও শেষ পর্যায়ে। পাঁচ দিনে সেই খাবার শেষ হয়ে যায়। এর পর থেকে খাবার বন্ধ। খাওয়ার পানিও ফুরিয়ে যায়। তেষ্টায় সবাই আমরা চিৎকার করি। কিন্তু পানি দেওয়া হয় না। এভাবেই না খেয়ে দিন কাটে। টানা ১০ দিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকি। কেউ চিৎকার করলেই নির্যাতন করা হতো। এর মধ্যে ক্ষুধার যন্ত্রণায়, পানির তেষ্টায় যাত্রীদের অনেকেই চিৎকার করতে থাকেন। থাইল্যান্ডের নাগরিকদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। তারা ফাঁকা গুলি করে আতঙ্ক ছড়াত। একসময় ক্ষুধায় আর পানির তেষ্টায় একে একে ১৩ জন ট্রলারেই মারা যান। আমার বন্ধু আফাজ ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে সাগরে ঝাঁপ দেন আমার সামনেই। আমিও না খেয়ে অসুস্থ। এক কোনায় পড়ে থাকি। ১৫ দিন পর ট্রলারটি উদ্ধারের জন্য আরেকটি ট্রলার আসে। তারা কিছু খাবারও নিয়ে আসে। ওই ট্রলার থেকে আমাদের ম্যাগি নুডলস দেওয়া হয়। আর দেওয়া হয় জিব ভেজানোর জন্য কয়েক ফোঁটা পানি। পরপর তিন দিন খাবার দেওয়া হয় শুধু সাদা ভাত। এরপর আবারও টানা আট দিন না খেয়ে থাকা। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয় নিয়ে একপর্যায়ে পৌঁছে যাই থাইল্যান্ডে। সেখানকার জঙ্গলে নিয়ে চলে নির্যাতন।’ সাহাবুদ্দিন জানান, এরা থাইল্যান্ডের অপহরণকারী। গুহায় এনে ফোনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে। গুহায় জ্ঞান ফিরে আসার পর ওখান থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। কিছু দূর যেতেই জঙ্গলে দেখা পান আরেক বাংলাদেশির। ওই বাংলাদেশি যুবক অপেক্ষায় ছিলেন তার এক পরিচিত ব্যক্তির জন্য। থাইল্যান্ডের অপহরণকারীরা টাকা পেয়ে ওই যুবককে ছেড়ে দেয়। ওই যুবকের সঙ্গেই বেরিয়ে তিনি দেশে ফোন করেন। তার বড় ভাই তাকে জানান, জনির লোকজন ২ লাখ ২০ হাজার টাকা এরই মধ্যে নিয়ে গেছে বাড়ি এসে। সাহাবুদ্দিন জানান, তার ভাই তাকে থাইল্যান্ডের বর্ডারে যেতে বলেন। তার পরামর্শে বর্ডারে যান তিনি। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন তাদের গ্রামের এক লোক। তার মাধ্যমে তিনি মালয়েশিয়ায় ঢুকে পড়েন। কিন্তু সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান সাহাবুদ্দিন। কারাগারে আটক থাকেন দুই বছর। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাংলাদেশ। সাহাবুদ্দিনের মতো অসংখ্য মানুষ জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এরা আর কেউ আগের মতো কর্মক্ষম নেই। কাজ করার ক্ষমতাই তারা হারিয়ে ফেলেছেন অল্প বয়সে। দেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকা কক্সবাজার থেকে রওনা হওয়া মানুষগুলোর স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে সমুদ্রে ডুবে গিয়ে, নয় তো প্রতারক দালালদের হাতে বন্দী থেকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে। তবু থেমে থাকে না অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা। বঙ্গোপসাগরপথে বাহন তাদের সাধারণ ট্রলার কিংবা কার্গো বোট। এভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পৌঁছতে লাগে সাত দিন সাত রাত। স্বপ্ন বুকে অবৈধ পথে যাত্রা করা মানুষগুলোকে বোঝানো হয়, ওই সময়টা কোনোভাবে পার করতে পারলেই হলো, তারপর মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড। সেখানে গেলেই মিলবে অনেক বেতনের চাকরি। জীবন বদলে নেওয়ার এই সুযোগ পেতে ট্রলারে চেপে বসে মানুষগুলো। ঘুণাক্ষরেও টের পায় না তারা উত্তাল সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যেতে বসেছে। নিজের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিয়ে অবৈধভাবে সাগরপথে পাড়ি দিয়ে অজানায় হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দেওয়া সাগরপথের এসব যাত্রীর বেশির ভাগেরই সলিলসমাধি ঘটে সেই উত্তাল সাগরেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর