সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আন্দোলনের আঁতুড় ঘর ছিল জগন্নাথ

রাজি উদ্দিন আহম্মেদ রাজু

আন্দোলনের আঁতুড় ঘর ছিল জগন্নাথ

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেন। তখন আমি জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ভিপি। সারা দেশের আন্দোলনের মূল আঁতুড়ঘর ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি বললেন, ‘রাজু! আমি ছয় দফা দিচ্ছি। তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’ আমি বললাম, ছয় দফা বিশ্বাস করি না। এক দফার কথা বলুন। স্বাধীনতার কথা বলুন। তাহলে আমরা আছি। বঙ্গবন্ধু চিৎকার দিয়ে উঠলেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি ছিল। বঙ্গবন্ধু আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘এই ছয় দফাই তোর স্বাধীনতা এনে দেবে।’ তখন বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তার ছয় দফা আমরা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেব। সে অনুযায়ী জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে লেবার এরিয়ার শ্রমিকদের নিয়ে আমার প্রথম মিটিং হয়। সভাস্থলে যাওয়ার পর ১৫ মিনিট আগে পুলিশ আমার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নেয়। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে খালি গলায় বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সেই মিটিংয়ে বলেছিলাম, সেই দিন কংগ্রেসের কাছে ১৪ দফা পেশ করেছিল মুসলিম লীগ। দাবি আদায় হয়নি বলেই পাকিস্তান হয়েছিল। আজ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ছয় দফা পেশ করলাম। যদি না মানে তাহলে পূর্ব পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানই থেকে যাবে। আর পশ্চিম পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানই থাকবে। ভেঙে যাবে মাঝখানের মিলনসেতু। এরপর সারা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মূলমন্ত্র ছড়াতে ময়মনসিংহ রওনা দিই। খবর পেলাম সেখানে আমাকে গ্রেফতার করতে পুলিশ ওত পেতে রয়েছে। আমি তখন ছাত্রদের সঙ্গে মিটিং করতে জামালপুর কলেজে চলে যাই। তখন জামালপুরের আসাদ মোহাম্মদ কলেজের অধ্যক্ষ ছয় দফার কথা শুনে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে কলেজ থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কলেজের গেটের সামনে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। তার নিচে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে ছাত্ররা জড় হতে লাগল। ছাত্রদের সামনে ছয় দফা তুলে ধরলাম। সেখান থেকে সরাসরি ঢাকায় চলে এলাম। ছয় দফা আদায়ে জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুললাম। ঠিক সেই সময় এলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তখন আমিই প্রথম জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমান নাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সামনে ছয় দফার পক্ষে বক্তৃতা দিই। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানাই। তারপর তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে গণআন্দোলন শুরু হলো। এভাবেই আমরা এগিয়ে যাই। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচন। তখন মওলানা ভাসানী বললেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই।’ সেই দিন বঙ্গবন্ধু যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধুর একক সিদ্ধান্তেই আমরা নির্বাচনে গেলাম। ইয়াহিয়া জারি করেছিলেন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক। একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ভুট্টো-ইয়াহিয়া খানদের ধারণা ছিল তারা নির্বাচনে জিতবেন। ওই ভোটে এমন জাগরণ সৃষ্টি হলো যে, আমরা প্রতিটি সিট পেতে শুরু করলাম। ৩০০ আসনের মধ্যে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করি। তখন বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করতে চাইলেন। এতে বাধা দেন ভুট্টো। ৩ মার্চ ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট ডাকলেন। পরে ভুট্টোকে খুশি করতে তিনি পার্লামেন্ট অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু সবাইকে নিয়ে মিটিং করে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। কেউ অফিস-আদালতে যেত না। কল কারখানায় যেত না। তারপর এলো ৭ মার্চ। সেদিন সোহরাওয়ার্দী ময়দানে সকাল থেকে লাখো মানুষের ঢল নামে। মঞ্চে উঠে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে শুরু করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিলেন। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আমরা ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। রাত ১২টার পর থেকে বিকট বিকট আওয়াজ। ঘুমন্ত বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাল পাকবাহিনী। গণহত্যায় মেতে উঠল তারা। চারদিকে আগুন জ্বলছিল। এক রাতে হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করল। সারা শহরে লাশ আর লাশ। পরদিন আমি সাইকেল নিয়ে হলের দিকে গেলাম। ওই সময় একজন আমাকে হলের ভিতরে যেতে নিষেধ করল। বলল সেখানে পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। হলের ভিতরে মৃতদেহগুলো দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। বাসায় ফিরে আসি। তখন বাবা আমাকে অন্য জায়গায় চলে যেতে বললেন। আমি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রায়পুরা আসনের এমপি। আমাকে পাকিস্তানি আর্মিরা খুঁজছিল। পরে রায়পুরায় এসে বিভিন্ন ইউনিয়নের পাড়া-মহল্লা ঘুরে ঘুরে যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে পাকবাহিনী নরসিংদী বাজারে বম্বিং করে। তখন পাকবাহিনী আমার খোঁজে রায়পুরা খানাবাড়ী পর্যন্ত চলে আসে। খবর পেয়ে আমরা হাসনাবাদের ব্রিজ ভেঙে ফেলি। বাধ্য হয়ে পাকবাহিনী ফিরে যায়। ১৩ এপ্রিল ট্রেনিংয়ের জন্য আমি কলকাতা যাই। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি ভাই ও সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তারা আমাকে বাংলাদেশ থেকে যুবকদের ট্রেনিংয়ে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী আমি দেশে ফিরে আসি। বাংলাদেশ থেকে যুবকদের ট্রেনিংয়ের জন্য কলকাতা পাঠানো শুরু করলাম। পরে ঢাকার মিরপুর আসনের এমপিসহ আমরা ১৫ জন এমপি বিহারের চাকুলিয়ায় ট্রেনিং নিতে যাই। ট্রেনিং থেকে ফেরার পর আমার ওপর দায়িত্ব পরে নরসিংদীতে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তৈরির। সে অনুযায়ী কাজ শুরু করলাম। সে সময় আমি ৩ নম্বর সেক্টরের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্সের চেয়ারম্যান ছিলাম। এরই মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়। আমরা বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠি। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। তাকে এয়ারপোর্ট থেকে সোহরাওয়ার্দী ময়দানে নিয়ে আসার প্রস্তুতি নিই। সে সময় সব কমিটি আমার হাত দিয়েই হয়েছে। কিন্তু আমি কখনো নিজেকে প্রচার করিনি। ধাক্কাধাক্কি করে আগ বাড়িয়ে ছবি তুলতে যাইনি। আমি নীরবে রাজনীতি করেছি। জগন্নাথ একটা ইতিহাস, জগন্নাথ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলে সেখানকার নেতারা ঘর থেকে বের হতেন না। জগন্নাথ কলেজের ছেলেরা গেলেই মিছিল-মিটিং হতো। মূল আন্দোলনের সূত্রপাত জগন্নাথ কলেজ থেকেই।

অনুলিখন : সঞ্জিত সাহা, নরসিংদী

সর্বশেষ খবর