মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

খালেদার জামিন ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত

এ আদেশ নজিরবিহীন ও অপ্রত্যাশিত : আইনজীবী
তারা রাজনীতিকীকরণের চেষ্টায় : অ্যাটর্নি জেনারেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

খালেদার জামিন ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া জামিন আগামী ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ সর্বসম্মত হয়ে এ আদেশ দিয়েছে। দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে আপিলের অনুমতি দিয়ে (লিভ টু আপিল গ্রহণ) চার সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ দাখিল করতে বলা হয়েছে আদেশে। এর মধ্যে প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে এবং পরের দুই সপ্তাহের মধ্যে খালেদা জিয়াকে আপিলের সারসংক্ষেপ দাখিল করতে বলা হয়েছে। আদেশের সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে       অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান উপস্থিত ছিলেন এবং খালেদা জিয়ার পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন প্রমুখ। এদিকে, আদেশের পর জামিনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এ আদেশকে নজিরবিহীন ও অপ্রত্যাশিত হিসেবে বর্ণনা করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বিষয়টিকে রাজনৈতিকীকরণের চেষ্টা করছেন বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

 

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পর থেকে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে বন্দী। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর মামলার নথি নিম্ন আদালত থেকে এনে তা দেখে ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেয় হাই কোর্ট। দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে সর্বোচ্চ আদালত ১৪ মার্চ জামিন স্থগিত করে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলে। সোমবার সেই আবেদন মঞ্জুর করে তাদের আপিলের অনুমতি দেওয়া হলো।

আদালতে যা হলো : গতকাল সকালে আদেশের শুরুতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘এটা কিন্তু আমাদের সবার ডিসিশন। সর্বসম্মতিক্রমে এ আদেশ দিচ্ছি।’ এরপর আদালত খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া জামিন আদেশ স্থগিত করে। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে আপিলের অনুমতি দিয়ে সারসংক্ষেপ জমা দিতে বলে। মামলাটি ২২ মে আপিল শুনানির জন্য রাখা হয়। আদেশের পর আপিল বিভাগ নিয়মিত কার্যক্রমে যায়। কিছু সময় পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘আমি দুঃখিত। আপনি কী আদেশ দিয়েছেন তা বুঝতে পারিনি।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মত হয়ে এ আদেশ দিয়েছি।’ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমি তা জানতে চাইনি। কোন যুক্তিতে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করেছেন তা জানতে চাই।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা নথি পর্যালোচনা করেছি।’ তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা তো মেরিটে (মামলার মূল বিষয়বস্তুতে শুনানি করিনি) বলিনি।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপিলে বলতে পারবেন।’ এ পর্যায়ে জয়নুল বলেন, ‘আপনারা সর্বোচ্চ আদালত। আপনারা যে আদেশ দেবেন শিরোধার্য। তবে ২২ মে অনেক দূর। আজকে যেভাবে লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করলেন, তা নজিরবিহীন। অতীতে এ ধরনের ক্ষেত্রে কোনো দিন লিভ (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে তো সব (অতীতের সব মামলায়) লিভই (লিভ টু আপিল) গ্রহণ করা উচিত ছিল।’ তখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ অফিসারকে ডেকে চার সপ্তাহের জায়গায় দুই সপ্তাহ করে দিতে নির্দেশ দেন। এ পর্যায়ে জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘ঠিক আছে। আপনি দুই সপ্তাহ করলেন। ২২ মে তারিখের ওই সময়টা এগিয়ে আনার অনুরোধ করছি।’

এ সময় ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন আদালতকে বলেন, ‘সরকার যে উদ্দেশ্যে এটা করেছে...। দুদক আর সরকার তো একাকার হয়ে গেছে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়।’ এরপর জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘সময়টা কমিয়ে দিন। এপ্রিলে দিন।’ এ পর্যায়ে বিচারপতি ইমান আলী বলেন, ‘তখন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি থাকবে।’ এ পর্যায়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘ভ্যাকেশনের আগে দিন।’ বিচারপতি ইমান আলী তখন বলেন, ‘আফটার ভ্যাকেশন।’ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আফটার ভ্যাকেশন হলে দিন নির্ধারণ না করলে তো একই থাকল!’ এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ৮ মে পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত রেখে ওইদিন আপিল শুনানির দিন নির্ধারণ করে দেন।

এ আদেশ নজিরবিহীন : খালেদার আইনজীবী : আদেশের পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই আদেশকে আমরা নজিরবিহীন বলতে বাধ্য হচ্ছি এ কারণে যে অতীতে এ ধরনের আদেশ দেশের সর্বোচ্চ আদালত দেয়নি।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশের নিম্ন আদালতগুলোকে গ্রাস করে ফেলেছে। উচ্চ আদালতকেও মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। আদালতকে এজন্য আমি বলেছি, দেশের মানুষ আপনাদের কাছে বিচার পাওয়ার আশা নিয়ে আসে। কিন্তু তারা আশাহত হলে এই বিচারপ্রার্থী মানুষের আস্থা থাকবে না। দেশবাসীর উদ্দেশে বলতে চাই, আমরা মর্মাহত। আমরা ব্যথিত।’ খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত আদেশ দিয়ে দিয়েছে, এখন আইনি লড়াই ছাড়া বিকল্প নেই। আরেকটি হচ্ছে রাজপথের আন্দোলন। তা তো সুপ্রিম কোর্টে করতে পারব না। তবে আমরা যারা আইনজীবী আছি, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তার (খালেদা জিয়া) কারামুক্তির জন্য।’

রাজনৈতিকীকরণের চেষ্টা হচ্ছে : অ্যাটর্নি জেনারেল : পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার এখন আর মুক্তি হবে না। তাকে কারাভোগ করতে হবে।’ খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের বক্তব্য নিশ্চয়ই খুব একটি ভালো উচ্চারণ নয়। জিনিসটাকে রাজনৈতিকীকরণের জন্য তারা চেষ্টা করছেন। এখানে খালেদা জিয়াকে সবরকম সুবিধা দিয়ে আদালত এ দণ্ড প্রদান করেছে। দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে আদালত যে কতখানি মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে, ন্যায়নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে তার প্রমাণ তার সামাজিক মর্যাদা ও বয়স বিবেচনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। যদিও অন্যদের ১০ বছর দিয়েছে। কাজেই এটা নিয়ে যারা রাজনীতি করতে চাইছেন, তারা নিশ্চয়ই সফল হবেন না। কারণ এটা কোনো রাজনীতির বিষয় নয়। এটা সাধারণ অপরাধের বিষয়।’

খালেদার আইনজীবীদের শেষ চেষ্টা : খালেদা জিয়ার বিষয়ে আদেশের পর নিয়মিত কার্যক্রমের মাঝে বেলা ১১টায় বিরতিতে যায় আপিল বিভাগ। সাড়ে ১১টায় আদালত আবার বসলে আপিল শুনানি এগিয়ে আনতে আরজি জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। কিন্তু শুনানির জন্য ঠিক করা ৮ মে তারিখ না বদলিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এ মামলা কোনো ধরনের মুলতবি ছাড়া বিরতিহীনভাবে শুনানি করা হবে।’ বিচারকদের সামনে দাঁড়িয়ে খালেদার অন্যতম আইনজীবী জমিরউদ্দিন সরকার করজোড়ে বলেন, ‘আদালতের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন, সবার পক্ষ থেকে করজোড়ে আবেদন করছি, খালেদা জিয়ার মামলা ভ্যাকেশনের আগেই শুনানির দিন ধার্য করা হোক।’ তখন বিচারক বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ৮ মে দিন ধার্য করেছি। আমরা প্রথমে যে আদেশ দিয়েছিলাম আপনাদের অনুরোধে তা পুনর্বিবেচনা করেছি। আদেশ হয়ে গেছে এখন আর পরিবর্তন সম্ভব নয়।’ এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালতকক্ষ থেকে বের হয়ে যান।

সর্বশেষ খবর