মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
নেপালে বিমান ট্র্যাজেডি

সেই ত্রিভুবন দিয়েই ফেরা

জুলকার নাইন, কাঠমান্ডু (নেপাল) থেকে

সেই ত্রিভুবন দিয়েই ফেরা

মাত্র কয়েকদিন আগে মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে আসেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থার কর্মী সানজিদা হক। সেখানে বসেই পরিকল্পনা করেন সপরিবারে বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার। ভুটান না নেপাল কোথায় যাবেন তা নিয়ে ছিলেন দোটানায়। শেষ পর্যন্ত নেপালকেই বেছে নেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দীর্ঘ সময় প্রেম করার পর বিয়ে করা স্বামী রফিক জামান ও একমাত্র ছেলে অনিরুদ্ধকে নিয়ে গত ১২ মার্চ দুপুরে সোবহানবাগের বাসা থেকে বের হয়ে চেপে বসেন ইউএস-বাংলার কাঠমান্ডুগামী বিএস-২১১ ফ্লাইটে। সানজিদা ও রফিক জামানের নেপাল ভ্রমণের বেশ সাজানো পরিকল্পনা ছিল। সেই হিসেবে দুপুর ২টার পরই তাদের রিসিভ করতে নেপালের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্রিভুবনে চলে আসে পূর্বপরিচিত এক নেপালি তরুণী ও হোটেলের গাড়ি। কিন্তু ত্রিভুবনে পা দেওয়া মাত্রই সব কিছু পাল্টে যায়। উল্টে যায় সব হিসাব। অন্যদিকে, ১৫ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা ছিল রকিবুলের। স্ত্রী হাসিকে নিয়ে হিমালয়ের দেশে ঘুরবেন নানা জায়গায়। তিনিও ত্রিভুবনে পৌঁছান একই বিমানে। সঙ্গে ছিল ইউএস-বাংলার রিটার্ন টিকিট। তাদের মতো রিটার্ন টিকিট নিয়ে  স্ত্রী ও শিশুকন্যাসহ ওই ফ্লাইটে চেপেছিলেন ফটোগ্রাফার ফারুক হোসেন প্রিয়কও। কিন্তু ১২ মার্চ ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন প্রিয়ক ও তার তিন বছর বয়সী একমাত্র কন্যা প্রিয়ন্ময়ী তামাররাও। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন প্রিয়কের স্ত্রী আলমুন নাহার এ্যানি। কিন্তু এই বেঁচে থাকা কি সত্যিকার বেঁচে থাকা? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের জুনিয়র-সিনিয়রদের মধ্যে ‘বস’ হিসেবে খ্যাত রফিক জামান সপরিবারেই চলে গেছেন পরপারে। যেমনটা ছুটিতে নেপাল গিয়ে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে জীবন থেকেই ছুটি পেয়ে গেছেন রকিবুল। ত্রিভুবনের দুর্ঘটনায় ভুবন ছাড়াই হতে হয়েছে এই দম্পতিকে। ১৫ দিনের ছুটি শেষ হওয়ার সাত দিন আগেই একই ত্রিভুবন বিমানবন্দর দিয়ে ঢাকা ফিরেছে তাদের মরদেহ। রকিবুলের ছুটি যে এখনো বাকি। এরকম বেশ কয়েকটি সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হয়েছে বিমান দুর্ঘটনায়। নিহত হয়েছেন ২৬ বাংলাদেশিসহ ৫১ জন। এক সপ্তাহজুড়ে নানান ঘটনা-প্রবাহের পর বাংলাদেশিদের ২৩ মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। গতকাল সকালে তাদের জানাজা শেষে কফিনে ভরে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাখা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিশেষ কার্গো বিমানে তোলা হয় ঢাকার উদ্দেশে।

অথচ মাত্র এক সোমবার থেকে আরেক সোমবার। হয়তো নেপালে এই ‘ট্যুর’ এরপরই নতুন দম্পতি তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনার জাল বুনত। হয়তো অবুঝ শিশু দুটি নতুন দেশের নতুন প্রকৃতির সঙ্গে মেতে উঠত। এরপর হয়তো কতজনের কতগুলো গল্প লেখা হতো স্মৃতির পাতায়। কতগুলো সেলফি জমত ফোনে। হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে কেউ লিখতেন, ‘আবার ফিরলাম দেশের মাটিতে’। সেই ফেরা সবাই ফিরলেন, কিন্তু ফেসবুকে আর লেখা হলো না, ‘আবার ফিরলাম দেশের মাটিতে’।

ডবমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো বাংলাদেশিদের মৃত্যুতে মায়ের মতো বেদনার্ত হয়েছেন রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস। তিনি সার্বক্ষণিক তদারকি করে ওই লাশগুলোকে ত্রিভুবন থেকে বিদায় জানান। অন্যদিকে, অন্য স্বাভাবিক সময়ের মতো ঢাকার বিমানবন্দরে হতভাগ্য ২৩ জনের স্বজনরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রিয়জনদের ফেরার আনন্দ ছিল না। কারণ তারা সফর শেষ করে আসেননি, তারা যে ফিরেছেন নিথর দেহ নিয়ে কফিনবন্দী হয়ে।

মৃত্যুমিছিলে কফিনবন্দী লাশগুলো ছিল মো. ফয়সাল আহমেদ, হুরুন নাহার বিলকিস বানু, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, সানজিদা হক, আঁখি মনি, এফএইচ প্রিয়ক, উম্মে সালমা, মো. নুরুজ্জামান, মো. রফিকুজ্জামান, অনিরুদ্ধ জামান, তাহিরা তানভিন শশী, মিনহাজ বিন নাসির, মো. রকিবুল হাসান, মো. মতিউর রহমান, মোসাম্মৎ আখতারা বেগম, মো. হাসান ইমাম, তামাররা প্রিয়ন্ময়ী, এসএম মাহমুদুর রহমান ও বিলকিস আরা এবং উড়োজাহাজের পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ, ক্রু খাজা সাইফুল্লাহ ও শারমিন আক্তার নাবিলার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর