মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ওদের টার্গেট শিশু

মির্জা মেহেদী তমাল

ওদের টার্গেট শিশু

রাজধানীর দক্ষিণখান। সকাল থেকে কাজী সুলতান আহমেদের চার বছরের শিশু প্রহরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘর থেকে কখন বেরিয়ে গেছে প্রহর কেউ খেয়ালই করেনি। ঘুম থেকে ওঠে কাজী সুলতান যখন তার ছেলেকে ‘আব্বু আব্বু’ বলে ডাকছিলেন তখনই সবাই বুঝতে পারেন প্রহর নেই। বাবার ডাক শুনে এ ঘর-ও ঘর যেখানেই থাকুক না কেন দৌড়ে ছুটে আসে প্রহর। অনেকক্ষণ ধরে যখন আসছিল না, তখন সারা বাড়ি খুঁজেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর তারা বাসার বাইরে খোলা জায়গায় খোঁজ করে। কোথাও নেই প্রহর। আত্মীয়স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশী ছুটে আসে। অজানা আতঙ্কে সবাই ছুটতে থাকে এদিক-সেদিক। কেউ বলছে ছেলেধরা নিয়ে গেছে। কেউ বলছে প্রহর কি তবে কোথাও পড়ে গেল নাকি! আশপাশে ছোটখাটো ডোবা-নালাও আছে। নানা লোকের নানা কথায় পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে কাজী সুলতান ও তার পরিবার। দুপুর হয়ে এলো কিন্তু কোথাও প্রহরকে খুঁজে না পেয়ে সুলতান আর তার স্ত্রী পাগলপ্রায়। শত শত মানুষের ভিড় তখন সেখানে। হঠাৎ সুলতানের পাশের ঘরে গগনবিদারী চিৎকার। সবাই ভাবছিল সন্তানকে না পেয়ে প্রহরের মা চিৎকার করছে। কিন্তু প্রহরের মায়ের মাথায় তো লোকজন পানি ঢালছে! তবে চিৎকার করছে কে? গিয়ে সবাই দেখতে পায়, সুলতানের ভাড়াটিয়া দম্পতি রানা ও মারুফা খাতুন। তারা আহাজারি করছেন। ‘আমার কী হলো গো, আমাগো পোলা জিলানীরে পাই না। কে নিল গো।’ এমন আহাজারিতে লোকজন হতবাক। বলে কী? তাদের সন্তানও নেই। বাড়িওয়ালা সুলতানের চার বছরের শিশুসন্তান প্রহর আর ভাড়াটিয়ার তিন বছরের জিলানী একসঙ্গে হাওয়া! আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ইতিমধ্যে কাজী সুলতানের ফোনে কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে ছেলের মুক্তির জন্য চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পুলিশ ও র‌্যাবকে জানানো হয়। পুলিশ আসে। আসে র‌্যাব। র‌্যাবের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অপহরণকারী আর কেউ নয়। ভাড়াটিয়া দম্পতি রানা ও মারুফা খাতুনই অপহরণকারী। মুক্তিপণের দাবিতে তারা প্রহরকে তুলে নিয়ে যায়। বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য করতে নিজেদের শিশুসন্তানকে লুকিয়ে রেখে নাটক সাজায়। র‌্যাব ২৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রহর আর জিলানীকে উদ্ধার করে। গ্রেফতার করে ভাড়াটিয়া দম্পতিকে। র‌্যাব জানায়, এরা ভাড়াটিয়াবেশী ভয়ঙ্কর অপহরণকারী চক্র। রাজধানীর দারুস সালাম এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় আট বছরের শিশু সিফাত আলী। সিফাতের বাবার কাছে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে দুর্বৃত্তরা। গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে জহিরুল ইসলাম নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে। জহিরুল ইসলাম হলো সিফাতদের ভাড়াটিয়া। জহিরুল পুলিশের কাছে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। বলেছে, ‘আর্থিক সংকট থেকে মনে হঠাৎ ধনী হওয়ার স্বপ্ন জাগে। এ কারণে বাড়িওয়ালার ছেলেকে অপহরণের পরিকল্পনা আঁটি। বাড়িওয়ালার ছেলে সিফাতকে দ্বিতীয় তলায় ভাড়া করা ঘরে ডেকে নিয়ে আসি। এরপর তার হাত-পা ও মুখ বেঁধে আটকে রাখি। তার বাবার কাছে মুক্তিপণের জন্য টাকা দাবি করি। কিন্তু তারা থানা পুলিশ করে। ঘটনা ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় রাতে তাকে হত্যা করি। পরে লাশ কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি ফেলে দিয়ে আসার জন্য। কিন্তু সুযোগ পাইনি। তার আগেই ধরা পড়ে যাই।’ ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার এনামুল হকের ঘর ভাড়া নেয় জনৈক পলাশ নামে এক ব্যক্তি। এর একদিন পর অপহৃত হয় বাড়িওয়ালার ৫ বছরের ছেলে মেহেরাজ। পরদিন বিকালে অপহরণকারী ফোনে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করা হলে গ্রেফতার  হয় পলাশ। পলাশ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে পুলিশকে জানায়, ওই দিন বিকালে পাশের দোকানে চকোলেট কিনে দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে অপহরণ করে সে। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে, আবার কখনো আসছে না। বিশেষ করে দেশের মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে ভয়ঙ্কর এই চক্রের তৎপরতা বেশি। দিন যত যাচ্ছে এই চক্র ততই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও কৌশলী হচ্ছে তারা। অপহরণকারীরা মোটা অঙ্কের টাকার লোভে এখন নিত্যনতুন কৌশল গ্রহণ করছে। বিভিন্ন এলাকার বাড়িওয়ালাদের শিশু অপহরণের টার্গেট করে তারা বাসা ভাড়া নিচ্ছে। তাদের সন্তানকে অপহরণ করে বিকাশের মাধ্যমে টাকা দাবি করছে। অপহরণের পর তারা পুলিশ র‌্যাবকে না জানানোর জন্য বলে। অন্যথায় অপহৃত শিশুকে হত্যা করা হবে বলে ভয় দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা তাদের সন্তানের জীবন বাঁচাতে অপহরণকারীদের কথা মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানায় না। এতে অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়। সময় পেরিয়ে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও আর কিছুই করার থাকে না বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। তারা এমন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জানানোর জন্য বলেছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা যেহেতু টার্গেট করেই বাসা ভাড়া নিচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই তারা সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলাফেরা করছে, যাতে কেউ তাদের সন্দেহ করতে না পারে। অপহরণকারী চক্র সাধারণত বাড়িওয়ালার সঙ্গে প্রথমে সুসম্পর্ক তৈরির পর বিশ্বাস অর্জন করে। পরিবারের মধ্যে তারা ঢুকে পড়ে। বাড়িওয়ালার নানা কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সুযোগ বুঝে বাড়িওয়ালার শিশুসন্তানকে নিয়ে সটকে পড়ে। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা পেলে কখনো কখনো মুক্তি দেয়। না পেলে শিশুর লাশ মেলে। আবার টাকা পেলেও আতঙ্কে শিশুকে হত্যা করে ফেলে। হালে এমন ঘটনাই হচ্ছে বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগে ভাড়াটিয়াদের ভোটার আইডি কার্ডসহ আনুষঙ্গিক পরিচিতি নিশ্চিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ভাড়াটিয়াদের পরিচিতি তালিকা সঠিকভাবে থানায় জমা দিয়ে রাখলে পুলিশেরও কাজ করতে সুবিধা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো অপহরণের ঘটনা ঘটলে ভিকটিমের পরিবার যথাসময়ে পুলিশকে তথ্য দিলে অপরাধীদের ধরতে সহজ হয়। বাড়ি ভাড়া দেওয়ার আগে ভাড়াটিয়া সম্পর্কে কিংবা বাসায় গৃহপরিচারিকা, দারোয়ান, ড্রাইভার নিয়োগ দেওয়ার আগে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়া উচিত। অপহরণের বিষয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, র‌্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের বিভিন্ন অপরাধের রহস্য উদঘাটন, অপরাধীদের গ্রেফতারসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। র‌্যাব শুরু থেকে যে কোনো ধরনের অপহরণ ও জিম্মি করে অর্থ দাবিসংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধ, অপহরণকারী চক্রকে শনাক্ত ও গ্রেফতারসহ অপহৃতদের উদ্ধারে সার্বক্ষণিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যেসব স্পটে অপহরণের ঘটনা ঘটছে সেসব স্পটে আমাদের টহল টিম বাড়ানো হয়েছে। আমরা দুর্ধর্ষ অপহরণকারী চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করেছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর