বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

অসম বন্ধুত্বের ভয়ঙ্কর পরিণতি

মির্জা মেহেদী তমাল

অসম বন্ধুত্বের ভয়ঙ্কর পরিণতি

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র মহিউদ্দিন মিশু। এক দিন সন্ধ্যায় তাদের কাফরুলের বাসায় ফিরছিল। পথেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। তার চিৎকারে ছুটে আসে পথচারীরা। ছিনতাইকারীরা এ সময় তার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। পথচারীদের মধ্যেই ছিলেন চলিশোর্ধ্ব একজন ভদ্রলোক। নাম হুমায়ুন কবির। তিনি গায়ে পড়ে মিশুর সঙ্গে পরিচয় হন। মিশু কি করে,  কোথায় থাকে—তার সব কিছুই হুমায়ুন কবির জেনে নেন। মিশু জানায়, তার বাবা একজন সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। হুমায়ুন কবির তার নিজের মোবাইল ফোন নম্বর মিশুকে দেন। মিশুর নম্বরটিও চেয়ে নেন। হুমায়ুন কবির তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। মিশুও নিজ বাসায় ফেরেন। পরদিন হুমায়ুন কবির মিশুকে ফোন দেয়। এ সময় মিশু বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ করে মাত্র বেরিয়েছে। তার সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুও আছে। মিশু ফোনে তার অবস্থান জানালে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘তুুমি দাঁড়াও, আমি কাছেই আছি। আসছি। একসঙ্গে কাফরুলে যাব। আমার অফিসও ওখানে।’ মিশু তার বন্ধুদের বিদায় করে দেয়। অপেক্ষা করে। কিছু সময় পরই হুমায়ুন কবির মিশুর সামনে হাজির। তারা খাবারের দোকানে গিয়ে বার্গার কিনে খায়। জোর করে হুমায়ুন কবির বিল পরিশোধ করেন। তারা দুজনই এক সঙ্গে কাফরুল পর্যন্ত যায়। এক দুদিন পর পরই হুমায়ুন কবির শিমুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যায়। এক সঙ্গে বাসায় ফিরে। এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। এক সময় শিমু হুমায়ুন কবিরকে নিজেদের বাসায় নিয়ে যায়। বাবা মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মিশুর বাবা মাও এতে কোনো কিছু মনে করেননি। হুমায়ুন কবির খুব তাড়াতাড়ি মিশুদের পরিবারের সঙ্গে মিশে যায়। পরিবারের একজন সদস্যের মতো যাতায়াত করতে থাকেন। একটি গার্মেন্টের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের ব্যবহার সবাই পছন্দ করতে শুরু করে। মিশুর সঙ্গে তার বন্ধুদের যোগাযোগ কমতে থাকে। অধিকাংশ সময় হুমায়ুন কবির তাকে সময় দেয়। যদিও তাদের বয়সের মধ্যে পার্থক্য অনেক। তথাপি তারা বন্ধুর মতোই চলাফেরা করতে থাকে। এক দিন সন্ধ্যা নামার পরও মিশু বাসায় ফিরে না আসায় মায়ের মনে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। মা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। ভাবছেন, ওর বাবা ফিরুক। তিনি অন্তত ছেলের খোঁজ নিতে পারবেন। সরকারি কর্মকর্তা শিমুর বাবা কিছুক্ষণ পরই বাসায় ফেরেন। ছেলে বাসায় ফেরেনি যেনে তিনিও দুশ্চিন্তা করছেন। মোবাইল ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না মিশুকে। কোথায় গেল মিশু? ও তো কখনো এমন দেরি করে না! পথে-ঘাটে কিছু হলো নাকি! রাজ্যের সব খারাপ চিন্তা বাবা-মায়ের মনে তখন। কিছুতেই যেন এসব চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে পারছেন না তারা। ছেলের খোঁজে ফোন দিচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু কোথাও কোনো খবর নেই। কেউ তাকে কোথাও দেখেছে কি না, সে খবরও কেউ দিতে পারছে না। সন্ধ্যা কেটে রাতের আঁধার বাড়তে থাকল, কিন্তু ছেলে তখনো ফিরল না। অজানা আশঙ্কায় বাবা-মায়ের মন ভারী হতে থাকল। তারা আর স্থির থাকতে পারছেন না। গভীর শঙ্কা আর উদ্বেগ নিয়ে বাসা থেকে বেরোলেন বাবা হাসিব আহম্মেদ (ছদ্মনাম)। একে একে খোঁজ চলে সহপাঠী, ইয়ারমেট ও অন্য ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের বাসায়, তারপর শহরে বসবাসরত পরিচিতদের বাসায়। মিশুর বন্ধুবান্ধব ঘনিষ্ঠরা খবর শুনে বাসায় আসতে শুরু করেছে। তারাও যে যার মতো করে খোঁজ নিচ্ছে। কেউ যাচ্ছে হাসপাতালে। কেউ খবর নিচ্ছে বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনে। মর্গেও খোঁজ নেওয়া হলো। কিন্তু কোথাও নেই মিশু। বয়স ২০ বছর হলেও একদম সাদাসিধে সরল ছেলে মিশু। যে কারণে সবাই ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। জীবনে বহু দুর্বিষহ রাত কেটেছে হাসিব আহম্মেদের পরিবারে। কিন্তু সেদিনের মতো দমবন্ধ করা দুর্বিষহ দীর্ঘ রাত আগে তাদের জীবনে আসেনি। পরদিন আশা-নিরাশার দোলাচলে হাসিব আহম্মেদ এবং তার আত্মীয়-স্বজনরা গেলেন ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসির প্রথম বর্ষের ছাত্র মিশু। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের জানাল, মিশু ক্লাস করেছে। এ খবর শুনে মিশুর বাবা ভাবছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই কী হলো মিশুর। নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। শিক্ষকদের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তিনি। বাসায় মিশুর মা এক রাতেই বিছানায় পড়ে গেছেন। তার সেবা চলছে বাসাতেই। মিশুর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে হুমায়ুন কবির, যিনি কাফরুলের রোড মাস্টার গার্মেন্টের জেনারেল ম্যানেজার। তার বয়স চল্লিশের উপর হলেও মিশুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল তাদের। খবর শুনে তিনিও ছুটে আসেন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রতিদিন একসঙ্গে আড্ডা দিতেন হুমায়ুন কবির। যে কারণে তিনিও আবেগ ধরে রাখতে পারছেন না। হাউমাউ করে কেঁদেই দিলেন। প্রথম দিন হাসিব আহম্মেদের ছোটাছুটির মধ্যেই সময় কেটে যায়। দিন শেষে রাত আসে। সাধারণত সবাই বাসায় ফিরে পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতের খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু হাসিব আহম্মেদের পরিবারে নেই কোনো শান্তি। সন্তানের খোঁজে ছুটছেন তারা বিভিন্ন স্থানে। থানায় জিডি করা হয়। র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা মাঠে নামে। কিন্তু মিশু নিখোঁজ রহস্য আরও ঘনীভূত হতে থাকে। তার খোঁজ মেলে না। অপহরণকারীদের শনাক্ত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ গোয়েন্দারা। ২০০৬ সালের ১৯ মে রাজধানীর কাফরুলের ন্যাম গার্ডেনের বাসার সামনের রাস্তা থেকে নিখোঁজ হয় মিশু। কে বা কারা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। রাজধানীতে একজন সরকারি কর্মকর্তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তান নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। যে কোনো মূল্যে মিশুকে উদ্ধারের জন্য পুলিশের ওপর চাপ আসে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। সময় গড়িয়ে যায়। মিশুর সন্ধান পায় না পুলিশ। জলজ্যান্ত সন্তান এমন হাওয়া হয়ে যাওয়ায় বাবা-মা পাগলপ্রায়। যুগ্ম সচিব হাসিব আহম্মেদ পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে ছোটাছুটি করছেন ছেলের সন্ধানের জন্য। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর খবর আসে মিশুর। অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির ফোন আসে সচিবের মোবাইলে। ‘হ্যালো, সচিব সাহেব! আপনার প্রাণপ্রিয় ছেলে মিশু আমাদের কব্জায়। ছেলেকে ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৬০ লাখ টাকা নিয়ে আসেন। এক হাতে টাকা দেবেন, আরেক হাতে ছেলেকে উঠিয়ে দেব। কোনো ধরনের চালাকি করবেন, ছেলেকে পাবেন না। পাবেন লাশ’। এমন কথা শুনে কোনো জবাব দিতে পারেননি হাসিব আহম্মেদ। ওপাশ থেকে ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। ওই নম্বরে বার বার চেষ্টা করেও খোলা পাওয়া যায়নি। ফোনে মুক্তিপণের দাবি করায় হতাশ হাসিব আহম্মেদ। তিনি এত টাকা কোথায় পাবেন, কে দেবেন-এমন চিন্তা তার মাথায় এখন নতুন করে। মিশুর মা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর্তনাদ করছেন আর বলছেন, ‘আমি বুঝি না, জানি না, আমার ছেলেকে ফিরায়া এনে দাও’। বাসা থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যান মিশুর বাবা। পুলিশের সঙ্গে দেখা করেন। মুক্তিপণের বিষয়টি জানান। কিন্তু পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দারা কিছুই করতে পারছে না। মিশুর সিনিয়র বন্ধু হুমায়ুন কবির রয়েছেন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে। যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই আছেন তিনি। সহযোগিতা করছেন ভীষণ। মিশুর বাবা তার ওপর খুশি। বিপদের সময়ে হুমায়ুন কবিরকে তিনি পাশে পেয়েছেন। এই দিনে কে কার সঙ্গে থাকেন!

দিন যায়, সপ্তাহ পেরোয়-সন্ধান নেই মিশুর। বাবা-মা আর কারও কাছে ধরনা দেন না। বাসার ভিতর বসে থাকেন। মাঝে-মধ্যে ফোনে যোগাযোগ করেন পুলিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে। হাসিব আহম্মেদ বাসায় শুয়ে আছেন। ছেলেকে নিয়েই সারাদিন চিন্তা তার। কয়েক দিন মুক্তিপণের জন্য ফোন এলেও এখন তা আর আসছে না। হুমায়ুন কবিরের গতিবিধি নিয়ে ভাবছেন মিশুর বাবা। তার কাছে কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল। কিন্তু তিনি কাউকে বিষয়টি প্রথমে বলেননি।

অপহরণকারীদের ফোন যখন আসত তখন হুমায়ুন কবিরকে কাছে পাওয়া যেত না। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেওয়ার জন্যও হুমায়ুন কবির মাঝে-মধ্যে পরামর্শ দিতেন। এসব নিয়ে সন্দেহ আরও বাড়ে। এক দিন কাফরুল থানায় গিয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন হাসিব আহম্মেদ। পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও পর্যবেক্ষণের জন্য পরামর্শ দেন যুগ্ম সচিবকে। এভাবেই ছোটাছুটি করতে করতে কেটে যায় প্রায় দেড় মাস। হুমায়ুন কবিরের কিছু কর্মকাণ্ডে মিশুর বাবা প্রায় নিশ্চিত, হুমায়ুন কবির এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ১৩ জুলাই তিনি কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন। হুমায়ুনকে গ্রেফতার না করে নানা কৌশল নেয় পুলিশ। নানাভাবে হুমায়ুন কবিরকে চাপ দেয়। কৌশলে এড়িয়ে যান হুমায়ুন কবির। একপর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেরা করে। স্বীকার করেন হুমায়ুন কবির। বলেন, মুক্তিপণের টাকার জন্য মিশুকে তার পরামর্শেই অপহরণ করা হয়। মিশু কোথায়? পুলিশের এমন প্রশ্নে, হুমায়ুন জানান, ‘ও আর নেই। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যে পাবনার শাহজাদপুর এলাকায় গিয়ে অপহরণে জড়িত আরও চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বেরিয়ে আসে সব ঘটনা। শাহজাদপুরের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলুদ খেতের মাটি খুঁড়ে মিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, হুমায়ুন কবির বন্ধুত্ব করেন মিশুর সঙ্গে। কৌশলে মিশুর পরিবারের সঙ্গে মিশে যান। হুমায়ুন কবিরের ধারণা ছিল যুগ্ম সচিবের অনেক টাকা আছে। যে কারণে মিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেন। কিন্তু তিনি মিশুর বাবার সঙ্গে থেকে বুঝতে পারেন, টাকা দিতে পারছেন না। যে কারণে ১৫ দিন পর তার সহযোগীদের তিনি জানান, মিশুকে মেরে ফেলতে হবে। কারণ ছেড়ে দিলে তাদের নাম ফাঁস হয়ে গেলে জেলে থাকতে হবে। যুগ্ম সচিব তাদের ছাড়বেন না।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসম বয়সের বন্ধুত্বেই কাল হলো মিশুর জন্য। তাকে প্রাণ দিতে হলো অল্প বয়সেই। অল্প কয়েক দিনের বন্ধুত্বেই সরল বিশ্বাসে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল হুমায়ুনকে। গোয়েন্দারা বলেন, বন্ধুত্ব সবার সঙ্গে করতে হয় না। সন্তানরা ভুল করলেও বাবা মায়েরও উচিত ছিল লোকটি সম্পর্কে জানা।

বিচারিক আদালত মিশু হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত। ২০১৭ সালের ২৯ মে ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আতাউর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— হুমায়ুন কবির, আবুল কালাম, তরিকুল ইসলাম, ইসহাক ও কালাম ওরফে নম কালাম। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— হাসেম দেও, রাজা ও বাদশা। রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের প্রত্যেকের এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে তাদের আরও ৭ বছর করে কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। দণ্ডিতদের মধ্যে আসামি কালাম ওরফে নম কালাম কারাগারে রয়েছে। রায় ঘোষণার সময় ওই আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়।

সর্বশেষ খবর