বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাংক ঋণ পায় সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংক ঋণ পায় সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান

মাত্র ১০ বছর আগেও কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না। ছিল না কোনো ট্রেড লাইসেন্স। ছিল না ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর (টিআইএন)। কিন্তু এ ধরনের অনেক মানুষই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এখন বড় ব্যবসায়ী। তাদের এভাবে ঋণ দেওয়া রহস্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে ব্যাংকগুলোর কাছে এমন মানুষের কদর বেড়েছে গত সাত-আট বছরে। ফলে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চাহিবামাত্রই ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে। হলমার্ক দিয়ে শুরু হয়েছিল। তারপর যোগ হয় বিসমিল্লাহ গ্রুপ। এরপর একই রকম ঘটনায় আলোচনায় আসেন আশুলিয়ার এক ব্যবসায়ী। এমনকি এক-এগারোর পরও যাদের খবর ছিল না, এমন কয়েকজনকেও এভাবে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংক ঋণ নিয়ে এভাবেই চলছে নানা অব্যবস্থাপনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আর জবাবদিহির ঘাটতির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ঋণ প্রস্তাবগুলো সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই না করেই অনেককে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সে ঋণ বাধ্য হয়েই খেলাপির তালিকায় নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এমনকি প্রতিবছর এভাবে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ অবলোপন (মূল হিসাব থেকে বাদ দেওয়া) করা হচ্ছে। আর এসব ঋণের অর্থ ফেরত না আসার আশঙ্কাই বেশি। ফলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বলে তারা মনে করেন। জানা গেছে, নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিচ্ছে একটি চক্র। এভাবে গত ১০ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে ব্যাংকিং খাত থেকে, যা আর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সাম্প্রতিক সময়েও নামসর্বস্ব একটি গ্রুপ অব কোম্পানিকে বিধি লঙ্ঘন করে একক গ্রহীতা হিসেবে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে একটি ব্যাংক। নিরুপায় হয়ে পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলো বিশাল পরিমাণ ঋণকে খেলাপির তালিকায় নিয়ে যাচ্ছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে শুধু কর্মকর্তাই নয়, ব্যাংকের কোনো কোনো পরিচালকের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঋণখেলাপিদের একটা বড় অংশই আছে, যাদের ঋণ দেওয়ার সময় সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। যাদের সম্পদ মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ম মানা হয়নি। এর ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর যারা শীর্ষ খেলাপি, তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। আবার এদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যারা ব্যাংকের পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাকেন। ফলে এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। আর ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে নিজস্ব তদারকি ব্যবস্থা। পাশাপাশি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে পরিচালকদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নানা ফন্দি-ফিকির করে মোটা অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিচ্ছেন অখ্যাত ব্যক্তিরা। কোম্পানি বা কারখানার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও ফোলানো-ফাঁপানো প্রোফাইল তৈরি করে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হয় ব্যাংকগুলোয়। আর এসব ঋণ প্রস্তাব কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দিয়ে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর দেওয়া মোট ৬ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নামসর্বম্ব একাধিক কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক আর বিসমিল্লাহ গ্রুপকেই দেওয়া হয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আলোচিত আরও কয়েকটি নামসর্বস্ব কোম্পানিকে ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য ফাঁস হয়েছে। ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন আর অডিট রিপোর্ট ঠিকমতো পর্যালোচনা করা হলে এ ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন না মানায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণগ্রহীতার সম্পদ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনিয়ম ঘটছে। এর অন্যতম কারণ হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। এ জন্য ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবাইকে মনোযোগী হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

জানা গেছে, নব্য ব্যবসায়ী, কোনো ধরনের বিনিয়োগ ছাড়া রাতারাতি বনে যাওয়া নামসর্বস্ব গ্রুপ অব কোম্পানিজের নামেও দেদার ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো, যার বেশির ভাগই পরবর্তী সময়ে অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঋণ নেওয়ার সময় আবেদনকারীরা ব্যাংকের পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে তা বোর্ডে অনুমোদন করিয়ে নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির অভাব, সময়মতো অডিট না হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ অডিট ঠিকমতো না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে দেশের পুরো ব্যাংকিং খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ খবর