বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিচার বিভাগ

আরাফাত মুন্না

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিচার বিভাগ

এখন আর সুপ্রিম কোর্টের মামলার কার্যতালিকা দেখতে মোটা বই সাদৃশ্য কজলিস্ট সঙ্গে রাখতে হয় না আইনজীবীদের। মোবাইল ফোনে এক ক্লিকেই পাওয়া যায় কজলিস্ট। সংক্ষিপ্ত আদেশও সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় অ্যাপস-ওয়েবসাইটে। মামলার সর্বশেষ অবস্থাও দেখা যায় এখানে। উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া জামিন আদেশ যাচাইও হয় অনলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে। বলা চলে সুপ্রিম কোর্টে বইছে ডিজিটাল হাওয়া। শুধু সুপ্রিম কোর্টই নয় অধস্তন আদালতগুলোতেও শুরু করা হয়েছে ডিজিটাল কার্যক্রম। সেখানে এখন সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে। অনলাইনের মাধ্যমেই হয় বিচারিক আদালতের বিচারকদের ছুটির অনুমোদন। বিচার ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল হলে সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয়ের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের কষ্ট লাঘব হবে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

আদালতে ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং সিস্টেম চালু বিচার বিভাগে ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ২০১৬ সালে সিলেটের ২০টি আদালতে পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাল এভিডেন্স রেকর্ডিং সিস্টেম চালু করা হয়। শিগগিরই এই সিস্টেম চালু করা হবে সারা দেশের আদালতগুলোতে। ঢাকার নিম্ন আদালতের কয়েকটি ভবনের বারান্দায় মনিটর বসানো হয়েছে। ফলে আদালতগুলোর মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে পারছেন বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা। আগে মামলা সম্পর্কে জানতে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো সংশ্লিষ্টদের। বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশনে বিচারকদের আরও অভ্যস্ত করতে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজনও করছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সারা দেশে বিচার বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন করার জন্য কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পটি এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিচার বিভাগ সত্যি সত্যিই বদলে যাবে। সুপ্রিম কোর্টের এই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মামলার দৈনন্দিন কার্যতালিকা, সংক্ষিপ্ত আদেশ ও রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করা হচ্ছে। একটা সময় ছিল কোন মামলা তালিকার কত নম্বরে আছে বা কী আদেশ হয়েছে এসব জানতেও দালালদের টাকা দিতে হতো। এতে বিচারপ্রার্থীদের অনেক সময় ব্যয় হতো। এখন সুপ্রিম কোর্টে দালাল টাউটদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন একজন বিচারপ্রার্থী নিজেই নিজের মামলার সব তথ্য জানতে পারছেন। তিনি আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিচারিক আদালতের জন্য দেওয়া সমস্ত সার্কুলারও প্রকাশ করা হয়। ফলে ওয়েবসাইটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আদালত সার্কুলার সম্পর্কে জানতে পারছে। আগে এখানেও অনেক সময় ব্যয় হতো। বিচারিক আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল ত্যাগ ও ছুটি সংক্রান্ত বিষয়সমূহও এখন অনলাইনেই হচ্ছে। ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মামলা নিয়ে বিচার প্রার্থীদের কোনো ভোগান্তি থাকবে না বলেই আশা করেন সুপ্রিম কোর্টের এই কর্মকর্তা।

সুপ্রিম কোর্টে অনলাইন কার্যতালিকা : সুপ্রিম কোর্টে কাগজের পাশাপাশি অনলাইনে প্রতিদিনের কার্যতালিকা প্রকাশিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের ওয়েব ঠিকানায় (www.supremecourt.gov.bd) গেলে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কার্যতালিকা, মামলার সংক্ষিপ্ত ফলাফল, সর্বশেষ অবস্থা, রায় ও আদেশ অনুলিপি অনলাইনেই পাওয়া যায়। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বার্ষিক ক্যালেন্ডার, প্রধান বিচারপতিসহ অন্য সব বিচারপতির নামের তালিকা, প্রধান বিচারপতিসহ অন্য সব বিচারপতির সংক্ষিপ্ত বায়োপ্রাফি, সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নামের তালিকা, কেস সার্চ, কজলিস্ট অ্যাপস, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বিভিন্ন নোটিস, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পাওয়া যায় ওয়েবসাইটেই।

জামিন আদেশ যাচাইও অনলাইনে : নিয়ম অনুযায়ী হাই কোর্ট থেকে কোনো আসামির জামিন হলে ওই আদেশ যায় সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে। বিচারিক আদালত থেকেই জামিনের চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে তা যায় কারাগারে। তবে চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে জালিয়াতি রোধে হাই কোর্টের জামিন আদেশ যাচাই করে নেয় বিচারিক আদালত। জামিন আদেশ যাচাইয়ের জন্য বিচারিক আদালত থেকে উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করা হতো টেলিফোনের মাধ্যমে। ফলে ভোগান্তির শিকার হতে হতো বিচারপ্রার্থীদের। আর এখন অনলাইনেই করা হয় জামিন আদেশ যাচাই। হাই কোর্টের আদেশের অনুলিপি আপলোড করা হয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট অনলাইন সফটওয়্যারে। অনুমোদিত ব্যক্তিরা নিজের ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে সফটওয়্যারে প্রবেশ করে জামিন আদেশ যাচাই করে নিতে পারেন।

নিম্ন আদালতের বিচারকদের ছুটিও অনলাইনে : আগে চিঠি ও ফ্যাক্সের মাধ্যমে ছুটি নিলেও বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমেই ছুটি নেন নিম্ন আদালতের বিচারকরা। ফলে ছুটি নিয়ে বিচারকদের ভোগান্তি অনেকটা কমেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, বিচারকদের ছুটির প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ই-এপ্লিকেশন সফটওয়্যারে প্রবেশ করেন বিচারকরা। এরপর ছুটির কারণ ও সময় লিখে অনুমতি চাওয়ার পর রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় এই সফটওয়্যারের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত জানায়। ফলে ছুটি নিতে বিচারকদের যে অসুবিধা ছিল তা অনেকটা দূর হয়েছে।

ভিডিও কনফারেন্সে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিচারকাজ : শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার পরিচালনার কাজ এগিয়ে চলছে। ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পের আওতায় ভিডিও কনফারেন্সে বিচার কাজ করা হবে। বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ টু প্রোগামের মধ্যে সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়েছে। এই পদ্ধতি চালু করা গেলে স্পর্শকাতর মামলার আসামি বা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিচারের জন্য আর ঝুঁকি নিয়ে আদালতে আনা-নেওয়া করতে হবে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

শিশু আদালতের ড্যাশবোর্ড : সম্প্রতি শিশু আদালতের জন্য আলাদা একটি ড্যাশবোর্ড চালু করার কাজ চলছে। এই ড্যাশবোর্ড চালু হলে এই আদালতের মামলা ও আদেশ সম্পর্কে বিচারপ্রার্থীরা খুব সহজেই জানতে পারবেন। সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কমিটি ও চাইল্ড রাইটর্স যৌথভাবে এই কাজটি করছে। খুব দ্রুত শিশু আদালতের জন্য ড্যাশবোর্ড চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান।

সর্বশেষ খবর