বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

দরজার ওপাশে মৃত্যুদূত

মির্জা মেহেদী তমাল

দরজার ওপাশে মৃত্যুদূত

বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন আখড়ায় গিয়ে ফেনসিডিল সেবন করত সাবিল। সেই বন্ধুরাই একসময় তাকে পরামর্শ দেয়, ‘চল আমরা এটা ছেড়ে দেই। এত টাকা দিয়ে ফেনসিডিল খাওয়ার কোনো মানে নেই। আগের মতো সেই ফিলিংসও পাওয়া যায় না।’ সাবিল বন্ধুদের পরামর্শ শুনে বলে, ঠিক বলেছিস। আগের মতো আর ফিলিংস নেই। মেজাজটা কেমন চড়া থাকে। তবে ওটা ছাড়তে হলে অন্য কিছু ধরতে হবে।’ বন্ধুদের মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘উপায় আছে দোস্ত। সেই আমার পথেই আসতে হবে। দেখিস না, ফেনসিডিলের প্রতি আমার আগ্রহ কমে গেছে।’ সাবিলের প্রশ্ন, ‘তুই কি ইয়াবার কথা বলছিস?’ বন্ধুটি বলে, ‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস। দোস্ত একদিন খেয়েই দেখ, তারপর বলিস’। সেদিন দুপুর ২টায় সাবিল তার সেই তিন বন্ধুকে নিয়ে মহাখালীর বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। বেরোনোর আগে তার মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয় সাবিল। কোথায় যাচ্ছিস এই ভরদুপুরে? মায়ের এমন প্রশ্নে সাবিল বলে, ‘আম্মা, আজ না আমার পড়া আছে! স্যারের বাসায় যাচ্ছি।’ মা শুনে আশ্বস্ত হন। বলেন, ‘বাবা ঠিক মতো সাবধানে যাস’। বাসার কাছ থেকে একটি অটোতে করে তারা যায় যাত্রাবাড়ী। সাবিলের সঙ্গে থাকা এক বন্ধু আগে ভাগেই ফোন করে রেখেছিল পরিচিত এক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে। এখন সেই ব্যবসায়ীর জন্য অপেক্ষায় তারা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেই ব্যবসায়ীর দেখা নেই। বার বার ফোন দিচ্ছে। ব্যবসায়ী বলছে, এই তো ভাই চলে আসছি, কাছেই আছি। এমন করতে করতে এক ঘণ্টা পর আসল সেই ব্যবসায়ী! সাবিলসহ অন্য বন্ধুরা খুব খুশি। জীবনে প্রথম তারা নতুন কোনো মাদক গ্রহণ করবে। ইয়াবা ব্যবসায়ীকে ব্যবসায়ী বলে মনে হলো না সাবিলের। তরুণ বয়সী একটি ছেলে তাদের সামনে আসে। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নেয়। খুব সতর্কতা নিয়ে এক হাত বাড়িয়ে দেয়। সাবিলের বন্ধু দ্রুত নীল রংয়ের ছোট পলি প্যাক তরুণটির হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। সাবিল পকেট থেকে তিন হাজার টাকা পরিশোধ করে। টাকা পেয়েই তরুণটি দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়ে। তারা দ্রুত একটি অটো রিকশা ভাড়া করে। সোজা সাবিলদের বাসায়। বাসার গেটে যখন তারা পৌঁছে তখন সন্ধ্যা ৬টা। জ্যামে আটকে থাকায় তাদের বেশি সময় লেগে যায়। ঘরে ঢুকতেই মায়ের মুখোমুখি সাবিল। কীরে এত দেরি কেন করলি বাবা? মায়ের এমন প্রশ্নে অপ্রস্তুত সাবিল। বলে, না আম্মা। রাস্তায় জ্যাম ছিল। সাবিল তার বন্ধুদের নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে। ইয়াবায় অভ্যস্ত বন্ধুটি পকেট থেকে ইয়াবার প্যাকেট বের করে সামনে রাখে। সাবিল তা ধরে দেখে। নাকের সামনে ধরে গন্ধ নেয়। বাহ! দারুণ গন্ধ! স্ট্রবেরির ফ্লেভার! বন্ধুটি বলে, হ্যাঁ, স্ট্রবেরির ফ্লেভার। দাঁড়া তোদের খাইয়ে দিচ্ছি। বন্ধুটি আরেক পকেট থেকে একটি লাইটার আর ফয়েল পেপার বের করে। দুই টাকার একটি নতুন নোটকে পাইপের মতো করে বানিয়ে নেয়। এরপর বন্ধুটি নিজেও খায়, সাবিলসহ তিনজনকে খাইয়ে দেয়। এই করতে করতেই রাত ৯টা। ২০০৭ সালে এভাবে ইয়াবার জগতে ঢুকে যায় স্বনামধন্য কলেজের মেধাবী ছাত্র সাবিল। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় সুপার শপের মালিক তার বাবা। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় সাবিল স্কুল জীবন থেকেই ছিল ভালো ছাত্র। পরিবারের আশা তাদের ছেলে এমন বড় হবে, সারা দেশের মানুষ তাকে চিনবে। কিন্তু ইয়াবায় হাতেখড়ি হয়ে গেছে সাবিলের। ঘুম থেকে উঠেই তার মাথায় ঘোরে ইয়াবা। কখন টাকা নেবে, আর কখন ছুটবে যাত্রাবাড়ী। কিছুদিন পর আর বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করে না সাবিল। নিজেই চলে যায় যাত্রাবাড়ী। একদিন ফোন করেই যাত্রাবাড়ী রওনা হয় সাবিল। যাত্রাবাড়ী পৌঁছে ইয়াবা বিক্রেতাকে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ। অপেক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ পেছন থেকে কয়েকজন এসে তাকে জাপটে ধরে। তাদের হাতে ওয়্যারলেস সেট। কারও হাতে পিস্তল আর লাঠি। বুঝতে পারে সাবিল এরা পুলিশ। তাকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে গাড়িতে উঠানোর চেষ্টা করে পুলিশ। সে পুলিশের হাতে-পায়ে ধরে। কান্নাকাটি করে। একজন পুলিশ সদস্যের কাছে কান্নাকাটি করে ছেড়ে দিতে বলে। আর কোনোদিন ওখানে যাবে না বলেও প্রতিজ্ঞা করে। পকেটে যা ছিল তা দিয়ে দেয় পুলিশ সদস্যকে। সেই পুলিশ সদস্য অন্যদের বুঝিয়ে তাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করে। পুলিশের এক সদস্য লাঠি নিয়ে তার পেছনে সজোরে দুটা ঘা দেয়। বলে আর কোনোদিন যেন এ পথে না আসে। লাঠি দিয়ে মেরেই বলে, যাও চলে যাও। সেদিন সাবিল ফিরে যায়। বাসায় গিয়ে কাপড় খুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেছনে ঘুরে দেখার চেষ্টা করে। শরীরে দুটো লম্বা লাল দাগ হয়ে আছে। যে সাবিল বাবা মায়ের কাছে কোনোদিন একটা থাপ্পড় খায়নি, সে আজ পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে বাসায় ফিরেছে। এমন সময় তার ফোন বাজে। যাত্রাবাড়ী থেকে ফোন এসেছে। ‘মাম্মা, পুলিশ আইছিল, তাই সইরা গেছিলাম। ফোন বন্ধ রাখছি। আপনি কৈ?’ ইয়াবা বিক্রেতার ফোন পেয়েই লাঠির আঘাতের কথা ভুলে যায় সাবিল। ফোনে সাবিল বলে, আমি আসছি। সাবিল তার মায়ের কাছে গিয়ে স্যারের বেতনের কথা বলে টাকা নেয়। মা তাকে ৫ হাজার টাকা দেয়। সেই টাকা নিয়ে পড়িমরি করে বেরিয়ে যায় সাবিল। সাবিলের এমন অস্থিরতা মায়ের চোখে লাগে। ভাবে, কী ব্যাপার। সাবিল এমন ছটফট করছে কেন ইদানীং! যাত্রাবাড়ী থেকে সাবিল যখন বাসায় ফিরে, তখন রাত ১০টা। যাত্রাবাড়ীতে একদিন ইয়াবা কিনতে গিয়ে দেখা হয় পুরানা বন্ধুর সঙ্গে। সেও ইয়াবায় আসক্ত। সেই বন্ধু তাকে বলে মগবাজারেও পাওয়া যায় ইয়াবা। মহাখালী থেকে মগবাজার পর্যন্ত দূরত্ব কম। সেখান থেকেই কেনাটা ভালো। এমন পরামর্শে সাবিল মগবাজার থেকেই কেনা শুরু করে ইয়াবা। দীর্ঘ দুই বছর ধরে মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে। সাবিল চিনতে পেরেছে শহরের বিভিন্ন ইয়াবার স্পট। যেখানে তার সময় বাঁচে সেখানেই ছুটে যায় ইয়াবা কিনতে। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে তার ইয়াবা সংগ্রহ আর সেবন করতে। তার বাসায় জানে, কলেজ আর স্যারের বাসা নিয়ে ব্যস্ত সাবিল। এভাবে চলতে থাকে সাবিলের জীবন। লেখাপড়ার প্রতি তার এখন আর আগের মতো আগ্রহ নেই। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করে না। বাবা তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দিনে দিনে তার খরচ বাড়ে। অতিরিক্ত টাকা নিতে গিয়ে তাকে চিৎকার করতে হয়। মুখ বুঝে সহ্য করে মা তাকে টাকা দিয়ে যায়। একটা সময় আফরোজা আহমেদ তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে সাবিলকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। স্বনামধন্য স্কুল থেকে যে ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণিতে পেয়েছিল বৃত্তি, এসএসসিতেও গোল্ডেন। সেই ছেলে কি না এইচএসসিতে ফেল! প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা ছেলেটি যেন আগের মতো আর নেই। ছেলের এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ আফরোজা জানতে পারে না। একদিন ধানমন্ডি থানা পুলিশের ফোন পেয়ে আফরোজা ছুটে যায় থানায়। দেখতে পান, তার ছেলে সাবিল হাজতে। পুলিশ তাকে ইয়াবাসহ গ্রেফতার করেছে। পুলিশের কাছেই প্রথম জানতে পারে তাদের সন্তান কয়েক বছর আগে থেকেই ইয়াবায় আসক্ত। আফরোজা থানায় বন্ড দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। ছেলের বাবাকে এ বিষয়ে বলতে পারছেন না তিনি। একা একা ছেলেকে বোঝান। ছেলেটি বোঝে না। নীরবে নিভৃতে কাঁদতে কাঁদতে আফরোজা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়েও তিনি তার ছেলেকে মাদকের পথ থেকে ফেরাতে পারছেন না। আফরোজা তার বড় সন্তানের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এদিকে সাবিল যেন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। টাকার জন্য বাসার জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে থাকে। সাবিলের বাবা বিষয়টি জানতে পেরে কষ্ট পান। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আর এ জন্য তিনি দায়ী করেন সাবিলের মাকে। যে পরিবারে এক সময় শান্তির বাতাস ছিল, সেই পরিবারে দিনে দিনে অশান্তি বাড়তেই থাকে। মায়ের কাছে টাকা না পেয়ে তাদের সুপার শপে গিয়ে ক্যাশ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে বেরিয়ে যায় সাবিল। আগে তার বাবা দোকানে থাকলে টাকা নিত না। কিছুদিন পর সাবিল যেন তার বাবাকেই চিনতে পারত না। তার সামনেই ক্যাশ থেকে জোর করে টাকা নিয়ে যায়। কেউ কিছু বলতে পারে না। তাকে জোর করে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করানো হলেও লাভ হয়নি। ফিরে এসে আবারও ইয়াবায় ঝুঁকে পড়ে। সাবিল জানতে পারে তাদের এলাকাতেই পাওয়া যায় ইয়াবা। এলাকা থেকে ইয়াবা কিনে বাসায় ঢুকে পড়ে। এরপর ইয়াবা বিক্রেতারাই তাকে বলে, মামা, আপনারে কষ্ট করে আসতে হবে না। ফোন দিবেন, আপনার বাসার দরজার সামনে হাজির হমু দুই মিনিটেই। সাবিল ভাবে, বাহ! কষ্ট করে আর বাইরে যেতে হবে না। দরজা খুলেই ইয়াবা পাওয়া যাবে। তাহলে তো আর কথাই নেই। বছরের পর বছর এ অবস্থার মধ্যে চলতে থাকে। একদিন সাবিল ধরা পড়ে তার বাবার কাছে। সাবিল নিজ রুমে ইয়াবা সেবনের সময় বাবা এসে হাজির। সাবিলকে চড় দেন। বাবাকে সাবিল ধাক্কা দিলে পড়ে যান তিনি। অসুস্থ হয়ে পড়েন সাবিলের বাবা। হাসপাতালে নেওয়া হয়। সাবিলের বাবা আর জীবিত ফিরেননি। কিছুদিন পর তাদের ব্যবসাতেও মন্দা। ব্যবসা চালানোর মতো কেউ নেই। সাবিলের ছোট ভাই এসবের মধ্যে নেই। সে তার হিস্যা চায়। ব্যবসা থেকে টাকা তুলে নেয় ছোট ভাই। ভিন্ন ব্যবসা শুরু করে সে। সাবিল তার মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়, আর বাসার দরজা খুলেই ইয়াবা কেনে। টাকা না পেলে এর কাছে, ওর কাছে টাকা চায়। বন্ধুরাও তার কাছে নেই। সচ্ছল বন্ধুরা তার কাছ থেকে দূরে থাকে। বন্ধ হয়ে যায় তাদের সুপার শপের ব্যবসা। এক সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে সাবিল। জন্ডিসে আক্রান্ত। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মা শুধু কাঁদেন।

আফরোজা আহম্মেদের পরিবারের ঘটনাই নয়, আছে অসংখ্য উদাহরণ। দেশের লাখ লাখ পরিবারে চলছে মাদকের দহন। ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষই মাদকের নীল বিষে আক্রান্ত। ভেঙে যাচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন। মাদকের ছোবল শুধু কারও একটি জীবন বিষাক্ত করছে না, গ্রাস করছে একেকটি পরিবার। একটি সন্তান, একটি মানুষ মাদকাসক্ত হলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে পুরো পরিবার। মাদকের নেশায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে সন্তান। সুশৃঙ্খল, সুন্দর জীবনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিভাবকদের উদাসীনতা আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততা ইয়াবার নেশায় বিষাক্ত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

মাদকের ভয়াবহ এ ছোবল থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও রাজনীতিকদের আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান আফরোজা আহম্মেদ। উদ্বিগ্ন এমন অভিভাবকদের অধিকাংশের অভিযোগ রাজনীতিক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মদদেই সর্বনাশা এই মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে আফরোজা আহম্মেদের মতো হাজারো মায়ের কান্না এখন ঘরে ঘরে। এই কান্না থামছে না। অসহায় এই মায়েদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। মাদক ইয়াবা এখন এতটাই সহজলভ্য হয়ে পড়েছে যে, মহাখালীর মতো সারা দেশের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা। বাসার দরজা খুললেই পাওয়া যায় ইয়াবা বিক্রেতাকে। যেন দরজার ওপাশে দাঁড়ানো থাকে মৃত্যুদূত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর