শনিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

কী আছে প্রতিরক্ষা নীতিমালায়

► প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি
► সংকট কাল নির্ধারণ করবেন সরকারপ্রধান
► যুদ্ধাবস্থা বা সংকটকালে সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
► জনগণ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিমালা, ২০১৮ অনুমোদনের পরই আলোচনা হচ্ছে কী আছে এতে? নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এরই মধ্যে নীতিমালাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলছেন, এ নীতিমালা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। যুদ্ধকালীন বা সংকটকালীন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সামরিক বাহিনীকে আরও বন্ধুপ্রতিম ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার গুরুত্ব দিয়ে সরকারের জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিমালা, ২০১৮-এর খসড়া গত সোমবার মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়; যার আলোকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তাবিষয়ক একটি জাতীয় কমিটি থাকবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ হিসেবে থাকবে এই কমিটি। প্রস্তাবিত ওই নীতিমালা অনুযায়ী যুদ্ধকালীন বা সংকটের সময় পুলিশ, বিজিবি, আনসারসহ সব আধাসামরিক ও সহায়ক বাহিনী পরিচালিত হবে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে। আর সংকটকাল বা ক্রান্তিকাল ঠিক করবেন সরকারপ্রধান। জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপযুক্ত পরামর্শ এবং কৌশলগত নির্দেশনা দিয়ে তা সামরিক কৌশলে রূপান্তর করার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি বন্ধুপ্রতিম গণমাধ্যম-সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত এই নীতিমালায়।

এই নীতিমালাকে ইতিবাচক বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বলছেন, এটি সময়োপযোগী। এ রকম একটি নীতিমালা আরও আগেই করা উচিত ছিল। একই সঙ্গে তারা মনে করেন, এ রকম একটি নীতিমালা করার ক্ষেত্রে পাবলিক ডিবেট করে জনগণকে সম্পৃক্ত করা উচিত।

গত সোমবার খসড়া এই নীতিমালা মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। যাতে বলা হয়েছে, নীতিমালার আলোকে নিরাপত্তাবিষয়ক একটি জাতীয় কমিটি থাকবে; যার নেতৃত্বে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। এটি হবে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ, যা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সরকারের মনোনীত মন্ত্রী ও মনোনীত সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এই কমিটির দায়িত্ব হবে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির মূল্যায়ন, জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুশাসন প্রদান, মন্ত্রিপরিষদকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভূমিকা পালন করা। নিরাপত্তাবিষয়ক জাতীয় কমিটির পক্ষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সমর পুস্তকের মাধ্যমে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের যুদ্ধকালীন দায়িত্ব নির্ধারণ করবে। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, শান্তি, সংকট ও যুদ্ধকালীন জাতীয় সক্ষমতা ব্যবহার করে সামরিক ও আধাসামরিক সংগঠনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের ব্যবস্থা করা হবে। দেশে কোনো যুদ্ধ বা বিরোধ শুরু হলে তিন বাহিনী, আধাসামরিক ও সহায়ক বাহিনীর যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে যৌথ আদেশ কেন্দ্র গঠন করা হবে। এই যৌথ আদেশ কেন্দ্রের নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানরা সদস্য হিসেবে এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও যৌথ আদেশ কেন্দ্রের সমন্বয়কারী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। নীতিমালায় সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তি সামাজিক ও সামরিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞ ও বিদ্বান ব্যক্তিরা সশস্ত্র বাহিনীকে সমাজের আরও কাছাকাছি নেওয়ার সমন্বিত প্রচেষ্টা নেবে। সশস্ত্র বাহিনী ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নীতিমালায়; যাতে অসামরিক ও সামরিক লোকজনের মধ্যে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, জাতীয় স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরোধমূলক কূটনীতি ও বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে। যে কোনো সংকট শান্তিপূর্ণভাবে মেটাতে কূটনৈতিক তৎপরতা, আলাপ-আলোচনা ও আন্তর্জাতিকভাবে মীমাংসার চেষ্টা করা হবে। এসব ব্যর্থ হলেই সর্বশেষ পন্থা হিসেবে সামরিক শক্তি প্রয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এ নীতিমালার আলোকেই জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নিরাপত্তা জোরদারের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ।

যুদ্ধ বা সংকটকাল ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীকে অন্যান্য দায়িত্বে মোতায়েন বিষয়েও এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও সক্ষমতার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে নিয়োজিত হবে। সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংস্থাগুলো দায়িত্ব পালনকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সামরিক বাহিনীকে এসব দায়িত্বে নিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ শান্তি মিশন ও অন্যান্য বৈদেশিক দায়িত্বে নিয়োজিত হবে। সশস্ত্র বাহিনীকে জাতীয় প্রয়োজনে অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকি প্রতিহত করার সক্ষমতা অর্জন করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়।

প্রস্তাবিত এই নীতিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ বলেন, প্রথমত হচ্ছে এই নীতিমালার কোনো ধারায় রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতা সংকুচিত হয় কিনা তা দেখতে হবে। এটা সংবিধানের একটা বেসিক পয়েন্ট। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা করার ক্ষমতার বিষয়ে সংবিধানে কী বলা হয়েছে এবং নীতিমালায় কী বলা হয়েছে তা গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। দেখতে হবে কোনোরকম সাংঘর্ষিক বিষয় আছে কিনা? তিনি বলেন, তবে এই পদক্ষেপকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হয়। প্রত্যেক দেশেই এ রকম নীতিমালা রয়েছে। যে কোনো দুর্যোগ, সংকট বা যুদ্ধকালীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলো যদি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকে তাহলে দোদুল্যমান পরিস্থিতি তৈরি করে। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটি উত্তরণে নীতিমালা জরুরি। আবদুর রশীদ বলেন, রাষ্ট্রের কাঠামোগত এ রকম সিদ্ধান্তের বিষয়ে পাবলিক ডিবেট করে জনগণকে সম্পৃক্ত করা উচিত। এতে কোনোরকম ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটি একটি যুগোপযোগী নীতিমালা। এ ধরনের একটি নীতিমালা অনেক আগেই করা যেত। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। আর যুদ্ধকালীন কিংবা সংকটে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার বিধান সব দেশেই রয়েছে। সে সময় দেশের অন্যান্য আধাসামরিক ও সহায়ক বাহিনী সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। সেনাবাহিনী নির্ধারণ করবে কে কোথায় কী করবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, এই নীতিমালার অনেক কিছুই আর্মি অ্যাক্টে আগে থেকেই আছে। এদিকে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিমালার খসড়া মন্ত্রিপরিষদে নীতিগত অনুমোদনকে স্বাগত জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তবে চূড়ান্ত করার আগে খসড়া সম্পর্কে জনগণের মতামত দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, টিআইবি আশা করে, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় এই নীতিমালার খসড়ায় জনগণের মতামত দেওয়ার সুযোগ তৈরি করলে নীতিমালাটি সঠিকভাবে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় তৈরি করার সুযোগ হবে।

প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি প্রতিরক্ষা নীতিমালা গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে তাঁর নিহত হওয়ার ঘটনায় সেই উদ্যোগ থমকে যায়। দীর্ঘ প্রায় চার দশক পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়নের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালের শুরুর দিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির খসড়া তৈরি করে জমা দেয়। ওই খসড়া নীতিমালার ওপর নবম জাতীয় সংসদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি ২০১০ সালের ২৭ জুন সংসদে প্রথম রিপোর্ট উত্থাপন করে।

সর্বশেষ খবর