শিরোনাম
শনিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাসপাতালেই মৃত্যু দূত

মির্জা মেহেদী তমাল

হাসপাতালেই মৃত্যু দূত

খুলনার মাছ বেপারি রতন কৃষ্ণ মজুমদার। অষ্টম শ্রেণি পাস। খুলনার এই মাছ বেপারি ঢাকায় এসে বনে গেছেন ‘অর্থোপেডিক সার্জন’! ভাঙাচোরা হাত-পা রীতিমতো অপারেশন করেন। রোগীদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ  ফুটো করতেন দেয়াল ছিদ্র করার ড্রিল মেশিন দিয়ে। তার সহকারীও আছেন। নাম তার বাবুল চন্দ্র পাইক। তিনিও অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ! খোদ রাজধানীতে খুলে বসেন ক্লিনিক। সে এক এলাহী কাণ্ড-কারখানা। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ধরে এনে তাদের এই ক্লিনিকে নিতেন। এরপর চলত তাদের নিজস্ব তৈরি চিকিৎসা ব্যবস্থা। বহু রোগী তাদের কবলে পড়ে সারা জীবনের জন্যে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। চিকিৎসার নামে সেখানে তারা গড়ে তোলে মানুষ মারার ফাঁদ। গোপনে তারা এই প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করলেও তা আর গোপন থাকেনি।

রাজধানীর ১৬/১৪ নম্বর বাবর রোডে এমনই এক অদ্ভুত হাসপাতালের সন্ধান পায় র‌্যাব। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ‘ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে’ অভিযান চালিয়ে গুণধর চিকিৎসক রতন কৃষ্ণসহ সাতজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে। সঙ্গে ক্লিনিকটিও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি বেশ কিছুদিন আগের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাছ বেপারির সেই ক্লিনিকটির সন্ধান পাওয়া গেলেও এমন মৃত্যুর হাতছানি দেওয়া ভুয়া ক্লিনিকের অভাব নেই সারা দেশে। ভুয়া চিকিৎসকদের গড়ে তোলা ভুয়া ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নিয়ে জীবন হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। জীবনের তরে পঙ্গু হওয়ার সংখ্যা অগণিত। ‘ন্যাশনাল কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে’ গ্রেফতারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া ডাক্তার সেজে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন। প্রায় দশ বছর আগে ছয়তলা ভবনের তিনতলায় হাসপাতালটি গড়ে তোলেন বাবুল চন্দ্র পাইক। তিনি বিভিন্ন ক্লিনিকে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ৫০ শয্যার লাইসেন্স হাতিয়েও নেন তিনি। এ রকম হাসপাতালের জন্য ১৫ জন ডাক্তার ও ৩০ জন নার্স থাকা বাধ্যতামূলক হলেও কথিত ক্লিনিকে ছিল না কোনো নার্স। তবে ছিল একজন ডাক্তার। পেশাদার দালালদের মাধ্যমে পঙ্গু হাসপাতালে আসা রোগী বাগিয়ে এনে এখানে ভর্তি করা হতো। এ ক্লিনিকে রোগ তো সারেই না, উল্টো মৃত্যুঝুঁকিতে থাকতেন রোগীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন সদস্য বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই পঙ্গু হাসপাতালের আশপাশে এভাবে কিছু হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। রোগীপ্রতি ৫০০ টাকা কমিশনে তারা রোগী বাগিয়ে আনেন। পরে বাকি বিলের ওপর আরও ৩০ শতাংশ কমিশন দেওয়া হয়। ২৫-৩০ জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজটি করছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’ র‌্যাব জানতে পারে, সেই রতন খুলনায় এক সময় মাছের ব্যবসা করতেন। কিছুদিন কারওয়ান বাজারে মাছের ব্যবসা করেন। পরে এ ব্যবসা ছেড়ে ভায়রার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) দায়িত্ব নেন। সেখান থেকেই তার এই ব্যবসায় নামা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নিউ ওয়েলকেয়ার হাসপাতাল নামে আরও একটি ক্লিনিকে হানা দেয় র‌্যাব। মাদক সেবন, ভুয়া চিকিৎসক ও ভুতুড়ে বিল তৈরিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ১২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড প্রদান করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। র‌্যাব জানায়, শেরেবাংলা নগর জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল থেকে দালালরা রোগীদের প্রতারণামূলকভাবে সুচিকিৎসার প্রলোভনে ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মৌখিক রেফার্ড করার মিথ্যা কথা বলে এবং বিভিন্ন অপকৌশলে নিউ ওয়েলকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার নামে প্রথমেই বিভিন্ন ধরনের ডায়াগনস্টিক টেস্ট, ওষুধ ও সার্জিকেল সামগ্রী ক্রয় ও সার্ভিস চার্জসহ একটি ভুতুড়ে বিল ধরিয়ে দেয়। রোগী ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে। মোহাম্মদপুর নিউ ওয়েলকেয়ার হাসপাতালে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে দেখতে পায়, গ্রামের অসহায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত রোগীদের ভয় দেখায়। তারা রোগীদের বলে, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হলে রোগীর হাত-পা কেটে ফেলতে হয়, আমাদের ক্লিনিকে আসুন ওষুধ দিয়ে সব ঠিক করে দেব। রোগীরা সেখানে ভর্তি হলে অপারেশনসহ ওষুধের বিল বাবদ লাখ লাখ টাকা দাবি করে। এমনকি টাকা পরিশোধ করার জন্য অনেকেই নিজের ভিটেমাটি বিক্রয় করেও নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। অনেক অসহায় রোগীকে রক্ত দেওয়ার নাম করে রক্তের ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখে রক্ত চলছে জানিয়ে গ্রামের রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিচ্ছে। র‌্যাব জানায়, দালালরা নিজেরাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দেয়। হাসপাতাল থেকে গ্রেফতারকৃত বি আর আহমেদ শরীফ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, প্রায় দুই বছর ধরে তিনি এই ক্লিনিকে বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক ডাক্তার পরিচয় দিয়ে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন।  তিনিই পঙ্গু হাসপাতাল থেকে বাগিয়ে আনা রোগীদের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে থাকেন। শরীফ নাম পরিবর্তন করে ডা. বি আর আহমেদ শরীফ, এমবিবিএস, এফসিপিএস (অর্থো.) পার্ট-২,-সহ ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র বা রোগের কোনো বিবরণ বলতে না পারলেও বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রি ব্যবহার করে আসছেন। তিনি স্বীকার করেন, রোগীর চিকিৎসার জন্য ওষুধ লেখার জন্য বিএমডিসি অনুমতি নেই এবং তাদের দেওয়া প্রেসক্রিপশনে একদিনে দশবার ইনজেকশন দিতে হবে  লেখা থাকলেও বাস্তবে তা রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অপকৌশল মাত্র। এ ছাড়াও বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক টেস্ট, সার্জিকেল সামগ্রী ও ওষুধ তাদের দেওয়া প্রেসক্রিপশনে লিখে থাকে এবং রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের সেসব ওষুধ, ডায়াগনস্টিক টেস্ট, সার্জিকেল সামগ্রী তাদের কাছ থেকে ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়, যা বিক্রি করে তারা বাজার মূল্যের চেয়ে অধিকহারে অর্থ অবৈধভাবে গ্রহণ করছে। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, দীর্ঘদিন থেকে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এখানে চিকিৎসা নিতে বাধা দিয়ে আসছে। অনেক সময় রোগীদের প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করায়। সেখানে চিকিৎসার নামে এসব রোগীর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। তিনি বলেন, রোগীদের কোনোভাবেই দালালদের প্রলোভনে পড়া ঠিক হবে না। প্রলোভনে পড়লে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর