রবিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

অবৈধ হুন্ডিতে সর্বনাশ

ডলারের একদিকে দাম বাড়ছে অন্যদিকে তারল্য সংকটে ব্যাংকিং খাত, খরা কাটছে না বিনিয়োগের, বৈধ পথে লেনদেন উৎসাহের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

অবৈধ হুন্ডিতে সর্বনাশ

অবৈধ হুন্ডি আর বিকাশের অপব্যবহার, বিদেশ থেকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে না আসার কারণেই গভীর সংকট তৈরি হয়েছে ডলারের বাজারে। একদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডলারের দাম, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে ডলারের ব্যাপক সংকট। এই সংকট উত্তরণের জন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আসতে হবে বৈধ পথে। একই সঙ্গে বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পুরো সিস্টেমের যেন কোনো ধরনের অপব্যবহার না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কেননা এখানে শুধু ডলার সংকটই নয়, নগদ অর্থের সংকটও তৈরি হয়েছে ব্যাংকগুলোতে।

ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ায় ব্যাহত হচ্ছে বিনিয়োগ। এ পরিস্থিতির উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা তৎপর। অথচ প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বৈধ পথে আনতে যা করা দরকার তা কেউ করছেন না। এ জন্য দরকার ব্যাংকিং খাতে বৈধ রেমিট্যান্স আহরণ আর হুন্ডিকে নিরুৎসাহিত করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হুন্ডির যে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে, তা ভেঙে নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ।

জানা গেছে, বিদেশে অবস্থানরত হুন্ডি ব্যবসায়ীদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে বিকাশসহ অন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অসাধু এজেন্টরা। এই অবৈধ হুন্ডির কারণে ব্যাংকের ছোট অঙ্কের রেমিট্যান্স আসা অনেকাংশে কমে গেছে বলে জানিয়েছে ব্যাংকাররা। এ সংকটের সমাধানে বাংলাদেশ ফিনানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নজরদারি আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে অবৈধ লেনদেন হচ্ছে এর প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকও পেয়েছে। এ জন্য তারা কিছু উদ্যোগও নিয়েছে। এটা মানি লন্ডারিং অপরাধ। এটা ঠিক যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে ফিনানশিয়াল ইনক্লুশন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর অপব্যবহারও হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রানীতি আইন অনুযায়ী, বিদেশ থেকে দেশে অর্থ পাঠাতে হলে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠাতে হয়। আর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাঠাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগাম অনুমতি নিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টরা বিদেশি হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলেমিশে অর্থ পাঠানোর কাজ করছেন, যা অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। গত বছরের শুরুর দিকে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিনে পরিদর্শন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান বাংলাদেশি প্রবাসীদের লেনদেন-সংক্রান্ত বিষয়াদি। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত দলটি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে যায়। তারা সেখানে দেখতে পায়, বাংলায় বিভিন্ন ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স নিয়ে দেশে পাঠানো হচ্ছে। একইভাবে বাংলাদেশ থেকেও টাকা পাঠানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিদেশের বিভিন্ন শপিং মলের বাংলাদেশি দোকানে বিকাশের মাধ্যমে কেনাকাটার অর্থও পরিশোধ করা হচ্ছে, যা মানি লন্ডারিং সমতুল্য ফৌজদারি অপরাধ। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে দুই হাজার ৮৭৭টি এজেন্ট বাতিল করেছে। সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাদের চাহিদামতো ঋণ দিতে পারছে না। এতে বিনিয়োগ বিঘ্নিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, উদ্যোক্তাদের চাহিদা মেটাতে না পারায় বিনিয়োগের খরা কাটছে না। ব্যাংকিং খাতে চলমান নগদ টাকার সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে যে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স লেনদেন অবৈধ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা আনা কিংবা বিদেশে টাকা পাঠানো সম্পূর্ণ অবৈধ। এটা বন্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে। চলমান ডলার সংকট কাটাতে না পারলে ব্যাংকিং খাতের সংকট আরও গভীর হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসাকে। এ জন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সতর্কও করা হয়েছে। জানা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় অনুমতি দেওয়া হয়েছে দ্রুত এবং সহজে ব্যাংকিং সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। তাই এতে যে কোনো অনিয়ম বা জাল-জালিয়াতি হতে না পারে সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি একটি কোম্পানির প্রতারণার কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের কীভাবে সহায়তা করা যায় সে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিবেচনা করে দেখছে বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর