বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

সেবাপ্রাপ্তিতে ঢাকাবাসীর পরিস্থিতি পীড়াদায়ক

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেবাপ্রাপ্তিতে ঢাকাবাসীর পরিস্থিতি পীড়াদায়ক

স্থপতি ইকবাল হাবিব

সেবা বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার নাগরিকদের অন্যতম সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে, নাগরিকদের প্রতি এখানে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। ঢাকায় একজন বস্তিবাসীকে একটি অভিজাত এলাকায় অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারীর তুলনায় প্রতি বর্গফুটে প্রায় আড়াই গুণ বেশি ভাড়া দিতে হয়, যা নিম্নবিত্ত নাগরিকদের জন্য এক ধরনের প্রবঞ্চনা। ঢাকার নিম্নবিত্তরা উচ্চবিত্তের তুলনায় বেশি ভাড়া দিয়েও সে অর্থে সেবা পাচ্ছেন না। আবার নাগরিক হিসেবে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো নিম্নবিত্তদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করছে না। এ হিসেবে নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঢাকাবাসী বিবর্ণ ও পীড়াদায়ক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। ইকবাল হাবিব বলেন, এই নগরী তার নাগরিকদের অনেক কিছু দিচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এই দেওয়াটা বৈষম্যমূলক। কারণ এই নগরীর সেবা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তরা তার নাগরিকদের মধ্যে ধনীদের বেশি সেবা দিচ্ছেন আর নিম্নবিত্তদের অনেক ক্ষেত্রে অস্বীকার করছেন। তাদের অস্তিত্বকে অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। যেমন নগরীর ৪৪ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে, আবার নিম্নবিত্ত হিসেবে কেউ কেউ ভাসমান আছে, কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন সেবা সংস্থা ও সরকার এদের শহরের কোনো প্রকল্প কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করছে না। সরকারি হিসাবে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। সরকার এই মানুষগুলোকে এ নগরীর বাসিন্দাও মনে করে না। বঞ্চনার কারণে নাগরিক সেবা শুধু ১৭ শতাংশ মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে। বাকিরা যে ছিটেফোঁটা সেবা পাচ্ছে, তা দিয়েই কোনোরকম দিন পার করছে। এই স্থপতি বলেন, ঢাকায় ধারণক্ষমতার বাইরে অনেক লোকের সমাগম হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবহুল শহর এখন ঢাকা। কিন্তু জনবহুল এই শহরের বাসিন্দারা নিজেদের নাগরিক দায়িত্ববোধ নিয়ে কতটা সচেতন তা একটি বড় প্রশ্ন। আর দায়িত্বজ্ঞানহীন নাগরিককে সব সুযোগ দেওয়াও সম্ভব নয়। সুবিধা পেতে হলে একজন নাগরিককে তার নাগরিক দায়িত্বও পালন করতে হবে। তবে নাগরিকের যে দায়িত্ব তা তার কাছ থেকে আদায় করার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হয়ে এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

ইকবাল হাবিব বলেন, ‘‘প্রতিটি নগরীর উন্নয়নের ধারা কী হবে এর জন্য আমরা ‘নগরায়ণ’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু ‘নগর দর্শন’ শব্দটির সঙ্গে আমরা মোটেই পরিচিত নই। এ জন্য আমাদের আগে ‘নগর দর্শন’-এর ধারণা তৈরি করতে হবে। আর নগর দর্শন তৈরি না হওয়ার জন্যই কিন্তু আমাদের আজকের নগরীকে কোনোভাবেই একটি বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি না। আবার নাগরিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন নাগরিকরাও একটি শহরের কাছ থেকে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী নাগরিক সেবা পেতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু এত কিছুর পরও এই নগরী যে পরিমাণ সেবা তার নাগরিকদের দিচ্ছে তা সুসমন্বিত না হলেও অন্য যে কোনো নগরীর তুলনায় কম নয়।’’ তিনি বলেন, ‘‘এই শহর ঘিরে যে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প চলছে তা ঢাকা শহরের মাত্রাতিরিক্ত ধূলিদূষণের কারণ। এ জন্য মৌলিক চাহিদাসহ অন্যান্য সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মানুষের ঢাকামুখী যে স্রোত, তা নিরুৎসাহিত করে ঢাকামুখিতা বন্ধ করতে হবে। আমাদের শৈশবে আমরা দেখেছিলাম, ভোরে মুষক দিয়ে নগরীতে পানি ছিটিয়ে সড়ক পরিষ্কার করা হচ্ছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর থেকে এই নগরী পরিষ্কারে পানির ছিটেফোঁটাও দেওয়া হয় না। এ ছাড়া ঢাকা শহরের যে সবুজের আবরণ ছিল তা ধ্বংস করে পাকা শহর তৈরি করা হচ্ছে। এতে করে একদিকে পুরো শহর ধূলিময় হচ্ছে, অন্যদিকে গাছপালা যেখানে আগে ধুলো ধরে রাখত, এখন তা ধ্বংস করায় বাতাসে তা উড়ছে। ধুলো থেকে বাঁচতে হলে ঢাকার চারপাশে ইটের ভাটা যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। আর যে সময় ধুলোর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তখন বৃষ্টিও হয় না, ফলে তখন ধূলিদূষণ ঢাকাকে ছেয়ে ফেলে। এ ছাড়া ধূলিদূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের নগরীতে ‘ছাদ বাগান’ বা ‘বারান্দা বাগান’-এর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এতে নাগরিকদের ঘরে তুলনামূলক কম ধুলো ঢুকবে।’’  অন্যদিকে ঢাকায় চলমান বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কারণে এবার বর্ষাতেও ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট ভোগান্তিতে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, এর মধ্যে অনেকগুলো ড্রেনেজ প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। একই সঙ্গে নগর উন্নয়নের বেশ কিছু সমন্বিত কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। আর জুলাই মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সমন্বিত কাজ শেষ হওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর কারণে সেটিও বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে এ বর্ষায়ও প্যানেল মেয়ররা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা কমিয়ে আনার আশ্বাস দেবেন বলে ধারণা করছি। আবার নগরীর খাল উদ্ধারেও কোনো সমন্বিত প্রকল্প নেওয়া হয়নি। খাল উদ্ধারে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি না হলে একটি খাল পরিষ্কার করার দেড় মাসের মাথায় তা আবার বেহাল দশায় চলে যায়। খাল উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সমন্বিত কর্তৃপক্ষ গঠন করা জন্যও পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের নিয়ে স্থানীয়রা খাল উদ্ধারে কাজ করবেন, খালগুলো প্রশস্ত করতে উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি সমন্বিত কার্যক্রমের অধীনে আনা এবং এ কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করাসহ পাঁচটি পয়েন্টের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। আর এগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়া খাল উদ্ধার কার্যক্রমে কোনো সুফল আসবে না বলে তিনি জানান। বাপার যুগ্ম-সম্পাদক বলেন, ফুটপাথ দখলমুক্ত কার্যক্রমে অভিযোগ দাখিল করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। কেউ জানেও না এ জন্য কার কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে। এ জন্য একটি দায়বদ্ধ কর্তৃপক্ষ দরকার। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন দায় নিতে চায় না। আর এভাবে যদি সবাই দায় এড়িয়ে চলে, তাহলে ফুটপাথ দখলমুক্ত করা আদৌ সম্ভব বলে আমি মনে করি না।

সর্বশেষ খবর