শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সামনে পাঁচ চ্যালেঞ্জ

শিমুল মাহমুদ, কক্সবাজার থেকে

মিয়ানমারের বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের সামনে এখন পাঁচটি চ্যালেঞ্জ। এই পাঁচ চ্যালেঞ্জ এখন তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্যও এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে— আসন্ন বর্ষায় ভূমি ধস থেকে রক্ষার জন্য রোহিঙ্গাদের দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তর, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী যুব রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মানব পাচার রোধ, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা এবং এদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গাদের সন্তানদের জাতীয়তা নিরূপণ করা। গতকাল দিনভর সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা ক্যাম্প কুতুপালংয়ে সরেজমিন পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব চ্যালেঞ্জের কথা জানা গেছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনে পালিয়ে আসা নতুন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তা, ত্রাণচাহিদা পূরণসহ সুশৃঙ্খল পরিবেশে ক্যাম্পে ধরে রাখতে পারা সেনাবাহিনীর বড় সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে। কক্সবাজারের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে এটি একটি বড় সংকট হিসেবে দেখা দিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ গত বুধবার পর্যন্ত নতুন আসা ১১ লাখ ৬ হাজার ৮৯৫ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বালুখালীসহ বিভিন্ন ক্যাম্পের অন্তত ২ লাখ রোহিঙ্গার জীবন চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, তাদের বসতিগুলো অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায়। ভারি বৃষ্টির সময় পাহাড় ধসে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হতে পারে একসঙ্গে। এ জন্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার উদ্যোগে উখিয়ার লম্বাখালী এলাকায় ১২৩ একর জায়গা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে দ্রুতই সরিয়ে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। বালুখালীর দুটি ক্যাম্পের ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা হচ্ছে ক্যাম্প ১৭-এ। কক্সবাজারে দায়িত্বরত আর্মি কোঅর্ডিনেশন সেল কর্মকর্তারা বলেন, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী যুবকদের আমরা সিকিউরিটি প্রোগ্রামে কাজে লাগাচ্ছি। নাইট প্যাট্রোলিং বা রাতের টহলে প্রতি ব্লকে ১০ জন করে রোহিঙ্গা যুবক কাজ করছে। প্রতিটি ক্যাম্পে ৩০০ জন করে যুবক নিয়ে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী যুব রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মোট নতুন রোহিঙ্গার অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এই সংখ্যাটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই বয়সী যুব রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা আবার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তারা রয়েছে মানব পাচারের ঝুঁকিতে। এ জন্য মানব পাচার রোধে মহাসড়কে আনসার, পুলিশ, বিজিবি ছাড়াও সেনা তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। এই এলাকায় যাতায়াতকারীদের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং অনেক তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মহার অনেক বেশি। তাদের প্রত্যেক পরিবারে ন্যূনতম ৫-৬ জন করে সদস্য। জন্মনিযন্ত্রণ বিষয়ে তাদের অনীহা রয়েছে। তাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা চলছে। তবে বিষয়টি এখনো ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অন্যদিকে গত ছয় মাসে বাংলাদেশে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের ঘরে হাজার হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। এখনো গর্ভবতী আছেন কয়েক হাজার নারী। এসব শিশুর জাতীয়তা পরিচয় কী হবে সেটা এখনো অমীমাংসিত প্রশ্ন। এ ব্যাপারে সরকারও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি।

এসব সংকট ও চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে দেশহীন, গৃহহীন মানুষের ওপর ছায়া হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে সেনা সদস্যরা প্রথম রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণ, প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও স্যানিটেশনের কাজ শুরু করে। গত ছয় মাস ধরে বিরতিহীনভাবে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে অসংখ্য কর্মসূচি চালাচ্ছে তারা। এ জন্য উখিয়া ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন এলাকায় জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ত্রাণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। এখানেই সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থার দেওয়া ত্রাণ জমা হয়। জমাকৃত ত্রাণ প্রতিদিন এখান থেকে ২৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সেনা সদস্যদের তত্ত্বাবধানে পাঠানো হয়।

আর্মি কোঅর্ডিনেশন সেল, উখিয়ার চিফ কোঅর্ডিনেটর লে. কর্নেল শাহ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, মিয়ানমারের বাস্তচ্যুত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে সুশৃঙ্খল পরিবেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আটকে রাখাই ছিল আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের মানবিকতার দিকটি সামনে রেখে সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় কাজ করে যাচ্ছি।

রোহিঙ্গারা প্রথম যখন আসতে শুরু করে তখন কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। তারা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে ঠাঁই নিয়েছিল। এই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ত্রাণ বিতরণেও বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলছিল। এ অবস্থায় সরকারের নির্দেশে সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা ফেরাতে ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। সেই থেকে চলছে রোহিঙ্গা শিবিরে সেনা সদস্যদের মানবতার কাজ।

সর্বশেষ খবর