রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোগান্তির শেষ নেই প্রবাসে

জুলকার নাইন

ভোগান্তির শেষ নেই প্রবাসে

ইউরোপের দেশ স্পেনে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে থাকেন লতিফ তালুকদার। সেখানে তার বসবাসের জন্য স্থায়ী রেসিডেন্স কার্ড রয়েছে। কয়েক দফায় তা নবায়নও হয়েছে। কিন্তু এবার তিনি পড়েছেন মহাসমুদ্রে। কারণ, আটকে গেছে কার্ড নবায়ন। আঙ্গুলের ছাপ জটিলতায় তার পাসপোর্ট আটকে গেছে। দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট না পাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন লতিফের মতো স্পেনের শতাধিক প্রবাসী। তাদের রেসিডেন্স কার্ড বাতিল হয়ে যায় কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশায় থাকা জব্বার হোসেন দুই বছর ধরে থাকেন মালদ্বীপে। দালালের মাধ্যমে সে দেশে গিয়ে যে কাজ পান, সেখানে পরপর চার মাস বেতন পাননি তিনি। পরে বেতনের টাকা চাইতে গেলে মারধরের শিকার হন। এখন সেখানকার একটি দ্বীপে ছোট দোকান খুলে ভালোই আয় করছেন জব্বার। কিন্তু দেশে থাকা পরিবারের কাছে টাকা পাঠানো নিয়ে তার ভোগান্তির শেষ নেই। শেষ পর্যন্ত ছয় মাস ধরে অবৈধ বিকাশের মাধ্যমেই টাকা পাঠাচ্ছেন তিনি।শুধু লতিফ বা জব্বার নন, বিশ্বের ১৬৮টি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১ কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির বেশির ভাগেরই কষ্টের শেষ নেই। বিশেষত শ্রমিক হিসেবে কাজ করা অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বাংলাদেশি প্রবাসীদের ভোগান্তি সীমাহীন। দালালের মাধ্যমে ৭-৮ লাখ টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়েও প্রতারিত হওয়া অনেকে নিজেদের ভাগ্য বদলের চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাজ পরিবর্তনের সুযোগ না পাওয়ায় সৌদি আরব, আমিরাতসহ কয়েকটি দেশে তাদের ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। ৮ লাখ টাকা খরচ করে গাইবান্ধার সেলিম কুয়েতে গিয়েছিলেন। ধারের টাকায় দালালের মাধ্যমে কুয়েত যাওয়ার পর সেখান থেকেই শোধ করেন সেলিম। এজন্য নির্ধারিত কাজের বাইরে ওভারটাইমসহ নানান কাজ করেন তিনি। কিন্তু ব্যাংকের মাধ্যমে বেতনের টাকার বাইরে কোনো টাকা পাঠানোর পদ্ধতি না থাকায় হুন্ডির আশ্রয় নিতে হয় তাকে।

মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকের কাজ ও থাকার পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডে কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে তাদের। এর বাইরে স্ট্রোক ও হৃদরোগে মৃত্যু হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কর্মীদের। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার কাতারে সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করা শাহাদাতের রুমমেট আবদুল হান্নানের মতে, কাতারপ্রবাসীদের প্রতিটি রাতই কাটে কষ্টে। ঠিকমতো থাকার জায়গা নেই। নেই কোনো খাবারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে গণরুমের জীবনযাপন আর ভালো লাগে না। সারা দিন কাজ করে রাতে গাদাগাদি পরিবেশে থাকায় নানা সমস্যায় ভুগছেন বাংলাদেশিরা। মাঝেমধ্যে মোবাইল ফোন সেট ও টাকা-পয়সা চুরি হয়। তিনি জানান, নিয়োগকারী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি না থাকায় যত সমস্যা পোহাতে হচ্ছে প্রবাসীদের। কারণ, কাতারে বৈধ প্রবাসীর পাশাপাশি অবৈধ প্রবাসীর সংখ্যাও অনেক। কোম্পানিগুলোর হয়রানির কারণে মূলত কাতারপ্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না কেউ।

ইরাকপ্রবাসী কুমিল্লার সালেহীন বলেন, ‘তিন বছর আগে কাজ করতে আসি ইরাকে। এখন বেশ খারাপ অবস্থায় আছি। বাসস্থানের অভাবে অনেক প্রবাসী হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে মারা যাচ্ছেন। ইরাক একটি উষ্ণাঞ্চল, প্রচণ্ড গরমে এমন পরিবেশে বসবাস করা খুবই কষ্টের। প্রবাসীদের সমস্যার শেষ নেই। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়, কিন্তু বেতন খুবই কম।’

পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ১৬ বছর আগে স্ত্রী-সন্তান দেশে রেখে সৌদি আরবপ্রবাসী গাজীপুরের ফজলুল হকে বলেন, ‘সৌদি আরবে আমি ১৬ বছর ধরে কিছুই করতে পারিনি। এর পরও আমাকে আবার চলে যেতে হবে। ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেই কাজ করতে হবে।’ মালয়েশিয়ায় অবৈধদের একদিকে যেমন রয়েছে গ্রেফতার আতঙ্ক, তেমন আগ্রহীদের দেশে ফেরার ক্ষেত্রেও ভোগান্তি চরমে। অবৈধ হওয়া বা ভিসা জটিলতায় প্রয়োজনে দেশে আসতে ট্রাভেল পাস পেতে দীর্ঘ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সব ঠিক থাকলেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও ট্রাভেল পাস পান না তারা, অথচ দালাল ধরলেই মেলে এটি। পাসপোর্ট হারিয়েছে বা দালাল কব্জা করেছে কিংবা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে অবৈধ হওয়ায় দেশে ফিরতে একমাত্র ভরসা এই ট্রাভেল পাস। শত শত প্রবাসী ভিড় করলেও অফিস টাইমের নির্ধারিত সময়ে ট্রাভেল পাসের জন্য নির্ধারিত কক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে না পাওয়ার অভিযোগও আছে। অবশ্য দূতাবাসে প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংগুলো। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এখন দূতাবাসমুখীই হন না প্রবাসীরা। আইএলওর ‘দ্য হোমকামিং : প্রোফাইলিং দ্য রিটার্নিং মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশই কোনো সমস্যায় পড়লে স্থানীয় দূতাবাসের সহায়তা নেন না।

প্রবাসী খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের ২৫টি দেশে বাংলাদেশের ২৯টি শ্রম উইং রয়েছে। তবে এসব শ্রম উইংয়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না। ফলে নানাভাবে তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অধিকাংশ শ্রমিকই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যাচ্ছেন। বিদেশে যাওয়ার পর খরচের টাকা তুলতে তুলতেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায় অনেকের। এ ছাড়া মালিকের প্রতারণা, ঠিকমতো বেতন না পাওয়া ইত্যাদি অনিয়মের পাশাপাশি অনেকে অসুস্থতা, নির্যাতনের শিকার হন। নারী শ্রমিকদের অবস্থা আরও করুণ। প্রতিনিয়ত নারী শ্রমিকদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।

অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর সেবার দুরবস্থার বিষয়টি জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচআরসি) পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। ইউএনএইচআরসি বলেছে, অযোগ্য কর্মকর্তাদের অপর্যাপ্ত কনস্যুলার সেবাতেই চলছে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর শ্রম উইং। অথচ বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে যৌন নির্যাতন ও জেন্ডারবৈষম্যও রয়েছে। এসব শ্রমিক যে কনস্যুলার সেবা পাচ্ছেন তা অপর্যাপ্ত। যে কর্মকর্তা এ সেবা দিচ্ছেন, তারও যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নেই। তারা শ্রমিকের সমস্যার বিষয়ে সংবেদনশীলও নন। শ্রম উইংগুলোয় পর্যাপ্ত সম্পদও নেই। আইনি সেবা খুবই উচ্চমূল্য এবং কর্মকর্তারা যে সময় সেবা প্রদান করেন, তা শ্রমিকদের জন্য অসুবিধাজনক; যার ফলে শ্রমিকরা সেবা নিতেও আগ্রহী হচ্ছেন না।

সর্বশেষ খবর