রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাড়ছে লাশের মিছিল

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ২৮ বছর বয়সী যশোরের চৌগাছা উপজেলার যুবক আনিসুর রহমান। গত ২১ মার্চ সে দেশে যান তিনি। মাত্র ২৯ দিনের মাথায় তিনি এখন লাশ। সৌদি আরবে গিয়ে দালালের মাধ্যমে কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করতেন আনিস। অন্যান্য দিনের মতো গত ১৯ এপ্রিল সকালেও কাজ শুরু করে তিনি। কিন্তু দুপুরের দিকে হঠাৎ ভবনের পাঁচতলা থেকে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পাঁচ ও দুই বছর বয়সী দুটি ছেলের বাবা আনিস সৌদি আরব গিয়েছিলেন ধারদেনা করে। আবার তার বৈধ কাগজপত্রও হয়নি সেখানে। ফলে কীভাবে আনিসের লাশ দেশে আসবে, কীভাবে ধারের টাকা শোধ হবে, আর কীভাবেই বা সংসার চলবে তা নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন আনিসের স্ত্রী আকলিমা। শুধু আনিসই নন, ভাগ্যোন্নয়নে বিদেশে গিয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। প্রতিদিনই প্রবাসীদের গড়ে প্রায় আট থেকে দশটি লাশ আসছে। মাত্র ২৫ থেকে ৩৫ বছরের এসব তরুণ-যুবকদের করুণ মৃত্যু হচ্ছে। গত ১২ বছরে এমন প্রায় ৩৪ হাজার লাশ গ্রহণ করেছে হতভাগা পরিবারগুলো। প্রতি বছরই বাড়ছে লাশের সংখ্যা। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই এসেছে ৬১৮টি লাশ। বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার পাশাপাশি করুণ মৃত্যু হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো আকস্মিক রোগে। কেন এত অস্বাভাবিক মৃত্যু তা নিয়েও নেই তেমন কোনো আলোচনা বা গবেষণা।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে ১ হাজার ২৪৮ জন, ২০০৬ সালে ১ হাজার ৪০২, ২০০৭ সালে ১ হাজার ৬৭৩, ২০০৮ সালে ২ হাজার ৯৮, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭ জন প্রবাসীর লাশ দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশে এসেছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে দেশে এসেছে ৬১৮ জনের লাশ। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। মোট মৃত্যুর ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের মরুর দেশগুলোতেই হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে প্রায় ৩০ শতাংশ। একক দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া থেকে আসছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লাশ। এরপরের তালিকায় ক্রমান্বয়ে আছে আরব-আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লিবিয়া। এর বাইরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লাশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ইতালি ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জনে অমানুষিক পরিশ্রম করা বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশিরভাগই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করেন, সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার সংস্থানও হচ্ছে না অনেকেরই। বাংলাদেশ থেকে গিয়ে অনেকেই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। বিপুল টাকা ব্যয় করে বিদেশে গিয়ে সেই টাকা তুলতে না পারার মানসিক যাতনাও অনেককে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর কোলে। আবার গাদাগাদি করে যেসব স্থানে তারা থাকছেন, সেখানেই সামান্য অসচেতনায় লেগে যাচ্ছে আগুন। অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত প্রবাসী এসব কর্মীকে সচেতন করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই নিয়োগকর্তা বা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের। অবশ্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের লাশ দেশে আনতে সহযোগিতা করে। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে দাফনের জন্য বিমানবন্দরে বোর্ড ৩৫ হাজার টাকা করে এবং পরে ৩ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদান দেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর