বুধবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিয়ন্ত্রণহীন সেবাবাণিজ্য

সরকারিতে সেবা নেই, বেসরকারিতে গলা কাটা দাম, বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন উচ্চবিত্তরা, মানুষ বাড়লেও বাড়ছে না মানসম্মত হাসপাতাল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

রায়হানের বয়স ২২ ছুঁইছুুঁই। বছর দুয়েক আগে প্রায়ই পেটে ব্যথা, বমিসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখা দেয় তার। সরকারি হাসপাতালে ভিড়-ঠেলাঠেলি এড়াতে প্রাইভেট ক্লিনিকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তার ব্যবসায়ী বাবা। ডাক্তার তাকে জানান গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার কারণে এক বছর তাকে কিছু ওষুধ খেতে হবে। ওই ওষুধ খাওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় হঠাৎ ব্যথার প্রকোপ বাড়তে থাকে। অন্য চিকিৎসক দেখে বলেন, অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ খাওয়ায় লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পেটে জটিল অপারেশন করতে হবে। বিভিন্ন ক্লিনিকে সেবা দেওয়া সরকারি ডাক্তারের কাছে ভিন্ন ভিন্ন মত পেয়ে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রায়হানের বাবা। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, খাবারে কিছু অসংলগ্নতায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। লিভার যেমন পুরোপুরি ঠিক আছে তেমনই গ্যাস্ট্রিকের জন্য উচ্চমাত্রার ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

এভাবে আস্থা আর আর্থিক টানাপোড়েনে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। বিশেষ করে ক্যান্সার ও স্নায়ুরোগীরা রয়েছেন জিম্মি অবস্থায়। প্রতি বছর এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও সরকারি হাসপাতালে নতুন করে অবকাঠামো সংযোজন হয়নি। ফলে হাসপাতালের মেঝে এমনকি করিডরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রকমের ফন্দিফিকির খুলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে পাঁচ তারকা তকমা লাগানো বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে তিন রুমে খুলে বসা ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ১৫ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাদের চিকিৎসার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় শয্যা আছে মাত্র ৫০০। অর্থাৎ এক শয্যার বিপরীতে রোগী তিন হাজার। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির জন্যও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। এ সেবা পেতে তিন থেকে চার মাস অপেক্ষা করতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে, সে অনুযায়ী ১৬ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে ১৬০ চিকিৎসা কেন্দ্র প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল; চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে ক্যান্সার হাসপাতাল ছাড়া কোনোটিতেই পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা নেই। হাসপাতালের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ৪৬ জন বিশেষজ্ঞ ও ৪২ জন প্রশিক্ষক পদের চিকিৎসক রয়েছেন। অর্থাৎ ১৭ হাজার ৪৫ জন রোগীর বিপরীতে একজন চিকিৎসক রয়েছেন। সরকারি পর্যায়ে কোনো অনকোলজিস্ট নার্স নেই। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে ক্যান্সার। আমরা ৭০ ভাগের সেবার প্রয়োজনে মাত্র ১ ভাগ পূরণ করতে পারছি। বর্তমান অবকাঠামোয় এর চেয়ে বেশি সম্ভব নয়। এজন্য দেশের ৩০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এটা চালু হতে ২০২২ সাল লেগে যাবে।’ শুধু ক্যান্সার নয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্নায়ুরোগী ও হৃদরোগীর সংখ্যাও। চিকিৎসকদের মতে, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে স্ট্রোক, ডিমেনসিয়াসহ মস্তিষ্কের নানা ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মাথা ও স্পাইনাল কডে আঘাত পায়, যা নিউরোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশ রোগীই নিউরো বিভাগের। এ ছাড়া দেশে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীও বেশি। এ রোগগুলো যত বাড়ছে, স্নায়ুজনিত রোগও তত বাড়ছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৫৫ লাখ। চিকিৎসার জন্য এদের প্রথম আস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল। নিউরো রোগীদের জন্য হাসপাতালটিতে শয্যা রয়েছে মাত্র ৩০০। যদিও বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগ মিলিয়ে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসছেন প্রতিদিন গড়ে ১ হাজারের বেশি রোগী। অন্যান্য হাসপাতালের মধ্যে বিএসএমএমইউতে নিউরোসার্জারি বিভাগে শয্যা রয়েছে ১০০টি। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫০, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০টি শয্যা রয়েছে স্নায়ুরোগীদের জন্য। পাশাপাশি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরো ওয়ার্ডে দুই শতাধিক রোগী থাকেন। এর বাইরে দেশের মেডিকেল কলেজগুলোয়ও সীমিত পরিসরে নিউরো রোগের চিকিৎসা করা হয়। হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। কিন্তু বাড়েনি হাসপাতালের অবকাঠামো। পেশেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রাকিবুল ইসলাম লিটু বলেন, ‘হাসপাতাল ও চিকিৎসকসংখ্যা বাড়াতে হবে। এজন্য দেশের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষায়িত রোগের জন্য ফাউন্ডেশন হাসপাতাল বা ওয়ানস্টপ ফাউন্ডেশন তৈরি করা যেতে পারে। এজন্য উত্তরা বা পূর্বাচলে ৫-৭ বিঘা জায়গা যদি সরকার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলেই জনগণ ও সরকারের সেতুবন্ধে নতুন সেবার রাস্তা তৈরি হবে।’

চিকিৎসাসেবার অপর্যাপ্ততায় বর্ধিত স্নায়ুরোগীদের অনেকেই দেশের বাইরে যাচ্ছেন। উচ্চবিত্তরা থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর বেছে নিলেও মধ্যবিত্তরা পাড়ি দিচ্ছেন পাশের দেশ ভারতে। চিকিৎসা ভিসায় ভারতে বাংলাদেশি পর্যটকের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিও একই কথা বলছে। ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব কমার্শিয়াল ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকসের (ডিজিসিআইঅ্যান্ডএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতে নানা রোগের চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি। এ ব্যাপারে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক জহির আহমেদ বলেন, ‘চিকিৎসায় পর্যাপ্ত সেবা না পাওয়া ও আস্থার সংকট রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে রোগীর তুলনায় অবকাঠামো-জনবলের ঘাটতি রয়েছে আর প্রাইভেট ক্লিনিকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ঘটনা ঘটছে। এর চেয়ে অনেক কম খরচে ভালো সেবা পাওয়া যাচ্ছে দেশের বাইরে। তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নগর। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক চাহিদা হলেও রাজধানীতে পরিকল্পিতভাবে নতুন কোনো হাসপাতাল গড়ে উঠছে না। এ বিষয়ে নজর দেওয়ার সময় এসেছে।’

এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘বেসরকারি চিকিৎসাসেবা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদনে বেসরকারি চিকিৎসাসেবায় নানা অভিযোগ ও সমস্যা সমাধানে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে কমিশনভিত্তিক বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। যেখানে চিকিৎসা ব্যয়ের ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক, সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মী, রিসিপশনিস্ট ও দালাল চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে। রোগ নির্ণয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাক্তার ও দালালদের ১৫ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন চুক্তি রয়েছে। উচ্চ মুনাফার জন্য বেসরকারি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোয় ব্যবসা চলছে। সেবাগ্রহীতাকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় হচ্ছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিধিমালা না থাকা এবং আইনের হালনাগাদ না হওয়াকেই স্বাস্থ্য খাতের এ সমস্যার জন্য দায়ী করা হয় প্রতিবেদনে। স্বাস্থ্যসেবার এই অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ খাতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। এজন্য বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু জবাবদিহিতা ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় গুরুত্বপূর্ণ এই খাত ঘিরে তৈরি হয়েছে নৈরাজ্য।’ এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের এই খাত নিয়ন্ত্রণ করার মতো সামর্থ্যও নেই প্রয়োজনও নেই। স্বায়ত্তশাসিত স্বাধীন একটি রেগুলেটরি কমিশন গঠন হবে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর