শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাড়ছে রোমহর্ষক খুন

মাহবুব মমতাজী

বাড়ছে রোমহর্ষক খুন

রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুল এলাকায় গত সপ্তাহের ঘটনা। ১৩ বছরের কিশোর আউসারের খোঁজ মিলছিল না। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় কাটছিল স্বজনদের। মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে সে পাওনা ৮০০ টাকা আদায় করতে যায়। খোঁজাখুঁজির প্রায় ৪ ঘণ্টা পর ধানক্ষেতে মেলে আউসারের লাশ। গালে আর ঘাড়ে ছিল অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। পরে তিনদিনের মাথায় বেরিয়ে আসে রোমহর্ষক তথ্য। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য বাবা জাহাঙ্গীরই আউসারকে খুন করেন।

৮ মার্চে ভরদুপুরের ঘটনা। তেজগাঁও থানার পশ্চিম নাখালপাড়ার ২৮৮ নম্বর রসুল ভিলা বাড়িতে ভাড়া নিতে এসে বাড়িওয়ালার স্ত্রী আমেনা বেগমকে (৬৫) কুপিয়ে হত্যা করে এক তরুণ। অজ্ঞাতনামা ওই তরুণকে ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটটি দেখাতে যেয়ে হামলার শিকার হন এ বৃদ্ধা। এরপর দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ এখনো খুনিকে চিহ্নিত করতে পারেনি। মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

একই কায়দায় দুবছর আগে দক্ষিণখান থানা এলাকায়ও বাসা ভাড়া নিতে এসে এক তরুণ বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা  করেছিল। সিসি ক্যামেরায় পাওয়া ওই কিলারের ছবি দিয়ে পুলিশ পোস্টারিং করা ছাড়াও ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিন্তু খুনির সন্ধান আজও মেলেনি। এরকম ঘটনা ছাড়াও রাজধানীসহ সারা দেশে ঘটছে বীভৎস, বিকৃত, রোমহর্ষক খুনের ঘটনা। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, আপনজনরাও ঘটাচ্ছেন অবিশ্বাস্য খুন-খারাবি। ছেলে খুন করছে বাবাকে, বাবা খুন করছেন ছেলেকে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বালুর ভিতর, ধানক্ষেতে, লাগেজের ভিতর, কাদার ভিতর, পানির ট্যাংকে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। জানা গেছে, এসব খুনের পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব। গত দুমাসে শুধু রাজধানী ও তার আশপাশে এমন খুনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০টি। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে অজ্ঞাতনামা আততায়ীর গুলিতে ময়মনসিংহের ছাত্রলীগ নেতা আশফাক আল রাফী শাওন আহত হন। পথচারিরা শাওনকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ভর্তি করে। আশঙ্কাজনক ডাক্তাররা তাকে অস্ত্রোপচার করে ১টি বুলেট বের করেন। একদিন পর শাওনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১২ দিনের মাথায় ৮মার্চ শাওন ঢাকা ইবনে সিনা হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানায়, এদের মধ্যে একজন রয়েছেন যিনি গুলি করেছেন। কিন্তু চাঞ্চল্যকর শাওন খুনে ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্রটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় শাওন খুনের আসল রহস্য উদঘাটন হচ্ছে না। অস্ত্রটি কোথায়? অস্ত্রটি কার? এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ময়মনসিংহে। অস্ত্র উদ্ধার বিলম্বিত হওয়ায় জনমনে সংশয়ও বাড়ছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রকৃত খুনিকে আড়াল করতে ঘটনার মোড় অন্য দিকে ঘোরানোর নীলনকশা তৈরিসহ আসল ঘটনা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চলছে। একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মহলের প্রভাবে এ হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দিতে অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে না।  পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডই বীভৎস ও রোমহর্ষক। এর মধ্যে ২০১৭ সালে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৯ জন। ২০১৬ সালে ৮৭৯ জন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫ জন, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন খুন হয়েছে। গত ৫ বছরে শুধু রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২১৮ জন, ২০১৬ সালে ৪৮ জন, ২০১৫ সালে ২৩৯ জন, ২০১৪ সালে ২৬২ জন, ২০১৩ সালে ২৪৫ জন। 

আরও ঘটনা : গত ৮ এপ্রিল সবুজবাগ থানা এলাকার বনশ্রীর পেছনে পূর্ব মাদারটেকে রাস্তায় সিএনজি থামিয়ে লাগেজ রেখে পালিয়ে যান এক তরুণী। পরে পুলিশ জানতে পারে লাশটি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শাহ আলম (৬৫) এর। গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে কনিকা নামে এক তরুণীকে গ্রেফতার করে। তার তথ্য মতে গ্রেফতার হয় তার প্রেমিক সৈকত। সৈকতের বাবা হলেন শাহ আলম। পুলিশ তদন্ত করে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করে। জানা গেছে, ২০১১ সালে সৈকতের সঙ্গে নিতুর বিয়ে হয়। তাদের ঘরে একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। গত বছর  মোবাইল ফোন সেট মেরামত করতে গিয়ে কনিকার সঙ্গে পরিচয় সৈকতের। এরপর থেকে তাদের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন এক দুপুরে কনিকা হাজির হন সৈকতের বাড়িতে। সৈকতের বাবা শাহ আলমের পা ছুঁয়ে সালাম করেন। এভাবে বছরখানেক প্রেম করার পর কনিকা জানতে পারেন যে সৈকত বিবাহিত। এতে কনিকার মন ভেঙে যায়। সৈকতকে বারবার চাপ দিতে থাকেন। নিতুকে ডিভোর্স দিয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য। বিষয়টি জেনে শাহ আলম ছেলেকে রক্ষা করার জন্য গত মাসে ৪ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি আরব পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল সৈকতের। এদিকে কনিকা পুলিশকে জানিয়েছে, শাহ আলম তার দিকে কুনজর দিয়েছিল। তাকে বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্যে সৈকতের বাবা চাপ দিতেন। এ কথা জেনে ভীষণ ক্ষেপে যায় সৈকত। বাবাকে খুনের পরিকল্পনা আঁটে। পরে পরিকল্পনা অনুযায়ী শাহ আলমকে কনিকা তার গোড়ানের ৩১ নম্বর টিন শেডের বাসায় ডেকে নিয়ে আসে। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। গত ১১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর কুুতুবখালী এলাকার জামিয়া নগর মাদ্রাসা রোডের মুখে একটি পরিত্যক্ত লাগেজ পাওয়া যায়। পুলিশ লাগেজ খুলে অর্ধকাটা এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে। লাশের পরিচয় এখনো পর্যন্ত মেলেনি। খিলগাঁওয়ের পুরনো পুলিশ ফাঁড়ি মাঠে স্থানীয় কিশোররা আয়োজন করে ডে-নাইট ক্রিকেট খেলার। গত ১২ এপ্রিল রাত ৮টায় শেষ হয় এ খেলা। খেলায় রাসেলের দল জিতে গেলে প্রতিপক্ষ দলের কয়েকজন তরুণ ও সমর্থক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় রাসেলের। মাঠ ছেড়ে বাসায় ফিরার পথে বউবাজার এলাকায় তাকে ছুরিকাঘাত করে প্রতিপক্ষরা। পরে এলাকাবাসী রাসেলকে উদ্ধার করে খিদমাহ হাসপাতাল এবং সেখান থেকে ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত রাসেল বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। সে খিলগাঁও পুরনো জামে মসজিদসংলগ্ন একটি বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকত। সে খিলগাঁও সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার ফলপ্রার্থী। বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। এ ঘটনায় পুলিশ আকাশ, রানা ও সিরাজ নামে তিন যুবককে চিহ্নিত করে। তবে তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর