শিরোনাম
শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

রমজান ঘিরে ঘাটে ঘাটে প্রতারক

জিরো টলারেন্সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ অভিযানে নামবে র‌্যাব, থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত

সাইদুর রহমান রিমন ও সাখাওয়াত কাওসার

রমজান ঘিরে ঘাটে ঘাটে প্রতারক

পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠছে নানা শ্রেণির অপরাধীরা। অন্য বছরগুলোর মতো এবারও ঘাটে ঘাটে বিস্তৃত করছে তাদের অপরাধ-প্রতারণার জাল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ে কারসাজি এবং ভেজাল পণ্য নিয়ে ওত পেতে আছে প্রতারক চক্র। মহল্লার ছিঁচকে মাস্তান থেকে শুরু করে পেশাদার অপরাধী-শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও আঁকছে বিশেষ ছক। বসে নেই অজ্ঞান পার্টি, থুথু পার্টি, ধাক্কা পার্টির দস্যুরা। রীতিমতো রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে জাল মুদ্রা ও এর বাজারজাতকারী সিন্ডিকেটের সদস্যদের। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অপরাধীদের অপতৎপরতা নস্যাৎ করতে রমজানে জিরো টলারেন্সে থাকবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। এ সংক্রান্তে ইতিমধ্যেই বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে মাঠ পর্যায়ে। শুরু হয়ে গেছে গোয়েন্দা নজরদারি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিভিন্ন অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে নামবে র‌্যাব। তৎপর থাকবে র‌্যাবের একাধিক মোবাইল কোর্ট। ভেজাল পণ্যসামগ্রী প্রস্তুত ও নকল পণ্য উৎপাদনকারী চক্রের দৌরাত্ম্য শুরুতেই বন্ধ করতে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে র‌্যাব, পুলিশ ও মহানগর গোয়েন্দা টিমগুলো। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও বিভিন্ন অপরাধ গ্রুপ ও প্রতারক সিন্ডিকেটকে টার্গেট করেই সাজানো হয়েছে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’। রমজানের আগেই র‌্যাবের টিমগুলো ব্যাপক তৎপর থাকবে। এরই মধ্যে র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স টিম বিভিন্ন অপরাধী গ্রুপ ও নকলবাজ কারখানাগুলোর খোঁজে মাঠে নেমেছে। র‌্যাবের মোবাইল কোর্টসহ বেশ কয়েকটি টিম এবার ইফতারিতে ভেজাল মেশানোর বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নেবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় যা করার তার সবটুকুই করবে র‌্যাব। এ সংক্রান্ত র‌্যাবের সব ব্যাটালিয়নকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিএসটিআইর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, রমজানে সাহরি ও ইফতারে বেশি ব্যবহার হয় এ রকম খাদ্য ও পানীয় ভেজালমুক্ত রাখতে কঠোর ভূমিকা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা আগাম অভিযান পরিচালনারও প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের অভিযানকালে ভেজালের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের মালিকদের শাস্তি পেতে হবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সূত্র বলছে, হাজারো প্রতারণায় দিশাহারা সাধারণ মানুষ। ঘর থেকে বের হলেই পদে পদে বিপদ। আছে শতেক প্রতারণার বেড়াজাল। চাঁদাবাজি, অপরাধ আর প্রতারণার ‘ঈদ ধান্ধা’য় অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। চলতি পথে, মার্কেট-বাজারে অজ্ঞান পার্টি, থুথু পার্টি, ধাক্কা পার্টির সীমাহীন দৌরাত্ম্য। রাজধানীতেই সক্রিয় রয়েছে পকেটমার চক্রের কয়েকশ সদস্য। হাজারো পয়েন্টে ওত পেতে থাকছে চাঁদাবাজ, ঝাপটাবাজ, ছিনতাইকারী চক্র। এসব চক্রের নানা অপরাধ আর অভিনব সব কৌশলের কাছে সাধারণ মানুষ ধরাশায়ী হচ্ছে, সব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি প্রতারণাও নিয়েছে ডিজিটাল রূপ। ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে যেমন অন্যের অ্যাকাউন্ট খালি করা হচ্ছে, তেমনি গলাকাটা পাসপোর্ট তৈরি, বিদেশি ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ও নিয়োগপত্র প্রস্তুত করলেও সহজে তা জাল প্রমাণের উপায় থাকে না। জাল টাকার ছড়াছড়ি তো বাজারজুড়েই আছে। ঈদ সামনে জাল টাকার অগণিত মেশিনপত্রে যেন ধুমছে ছাপা চলে টাকার। ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট উল্টেপাল্টে দেখেও বিশ্বাস করতে চান না দোকানিরা। পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) রৌশন আরা বলেন, প্রতি বছরই রমজান মাস ঘিরে নেওয়া হয় বিশেষ পরিকল্পনা। ঈদে ঘরমুখো মানুষের ফেরা এবং আসা নিশ্চিত করতে এবং প্রতারক-অপরাধীদের ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা এরই মধ্যে সবকটি মেট্রোপলিটন, রেঞ্জ এবং জেলায় পাঠানো হয়েছে। পবিত্র এই মাসকে অপব্যবহার করে অপরাধীরা যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ সতর্ক থাকবে পুলিশ। পরিস্থিতি স্বাভারিক রাখতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে বলে জানান পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। 

সবচেয়ে বেশি দৌরাত্ম্য নকল-ভেজালে : রমজানে ইফতার ও সাহরিতে ব্যবহূত খাদ্য পণ্যগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ভেজাল মেশানো হয়। অস্বাস্থ্যকর, নোংরা অবস্থায় রক্ষিত বস্তা পচা দুর্গন্ধের খেজুর, ইউরিয়া সার মেশানো মুড়ি, পোড়া মবিলে ভাজা চানাচুর আর টেক্সটাইল মিলে ব্যবহূত রঙে রঙিন করা খাদ্য সামগ্রীর রমরমা বেচাকেনা চলে সর্বত্র। চলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের সেমাই তৈরির ব্যবসা। দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের নামে নকল সেমাই প্যাকেট জাতের ব্যবসাও জমে উঠেছে। মাছ, মাংস, চাল, আটা, তেল, ঘি, ফলমূল, শাকসবজি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ সব কিছুতেই ভেজাল। বাদ থাকছে না শিশু খাদ্যও। ঈদে প্রসাধনের চাহিদা বেড়ে যায় বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে। এ সুযোগে রাজধানীর নকল প্রসাধনী ব্যবসার কুশীলবরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শুধু খাদ্যপণ্য নয়, ব্যবহার্য সব পণ্যসামগ্রীতেও পড়ছে ভেজালের ছোঁয়া। ইট, সিমেন্ট, রড থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীও মানসম্পন্ন পাওয়ার গ্যারান্টি নেই। বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, সীমিত তৎপরতা ও মাসোয়ারার দৌরাত্ম্যে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। মানসম্পন্ন পণ্য ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ ক্রেতাস্বার্থ রক্ষায় কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রতি বছর দু-চার মাস অন্তর ভেজালবিরোধী মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ইদানীং অভিযানের ব্যাপারে সংস্থাগুলো নীরব-নির্বিকার। তবে মাঝে মাঝেই র‌্যাবের পক্ষ থেকে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত এই সিন্ডিকেটের টেনশন বাড়িয়ে দেয়। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী মাসের ৬ তারিখ থেকে রমজান উপলক্ষে বিশেষ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। ইতিমধ্যে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের একাধিক টিম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর বাইরে তো আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছেই।

অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টি বড়ই ভয়ঙ্কর : ঈদ সামনে রেখে অপরাধ তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে মৌসুমি অপরাধীরা। ছিনতাই, চাঁদাবাজি সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পকেটমার, মলম পার্টি, টানা পার্টি, অজ্ঞান পার্টি চক্রের তৎপরতা। মাঝে-মধ্যে পুলিশের হাতে চক্রের কিছু সদস্য ধরা পড়লেও অধিকাংশই থাকে অধরা। যাদের আটক করা হয় তারা আইনের ফাঁক গলে বাইরে এসে আবারও একই কাজ করে থাকে। জানা গেছে, রাজধানীর বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেলস্টেশনসহ অর্ধশত স্পটে ছদ্মবেশে এসব চক্রের সদস্যরা সক্রিয়। প্রায় প্রতিদিনই তাদের কবলে পড়ে টাকা-পয়সা, মোবাইল, মানিব্যাগসহ অন্যান্য জিনিসপত্র খুইয়ে মুমূর্ষু হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন অনেকেই। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েও নিস্তার মিলছে না। অনেক ক্ষেত্রে হারাতে হচ্ছে জীবন। চলতি মাসে অর্ধশতাধিক মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। রমজানকে টার্গেট করে অজ্ঞান পার্টি চক্রের নেতারা ঢাকার বাইরে থেকে দৈনিক ভিত্তিতে লোক ভাড়া করে আনছে। বাসে হকারির পাশাপাশি ফুটপাথে ইফতারি-ডাব-শরবত বিক্রি করবে তারা। ক্রেতাদের অজ্ঞান করে টাকা ও মালপত্র লুটে নেওয়ার পর দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সটকে পড়ার কৌশল নিয়েছে তারা। ফলে ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে এসব অপরাধী।

অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আগাম তৎপরতা : সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রমজান মাস ঘিরে প্রতিবছরের মতো এবারও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিত্যপণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। আর তা বন্ধে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। এ বছর সরকার রমজান মাসে বাজার মূল্য স্থির রাখতে রোজার আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করেছে। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগাম তথ্য সংগ্রহে মাঠে নেমেছে। রমজানে রাতারাতি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যদিও বাজারে পণ্যমূল্য ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত দামে বিক্রির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অসাধু চক্র রোজার মাসের প্রয়োজনীয় পণ্য মসুর ডাল, পিয়াজ, রসুন, বেগুন, চিনি, মসলা, দুধ, শিশুদের গুঁড়ো দুধ, ছোলা ও মাংসসহ ইফতারিতে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের পণ্য আগাম আমদানির পর মজুদ করে। পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধির কথা বলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। তারপর তাদের চাহিদামতো অতিরিক্ত মূল্যে ওসব পণ্য বিক্রি করে। ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, ওয়াইজঘাট, ডালপট্টি, চকমোগলটুলী, শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ী, কাওরানবাজার, মোহাম্মদপুর, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য আমদানিকৃত পণ্য মজুদ করে থাকে। এ বছর রোজার মাস শুরুর ১০-১২ দিন আগে থেকেই অনেক নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়। আর তা ঠেকাতেই চলছে গোয়েন্দা নজরদারি।

তৎপর জাল টাকার সিন্ডিকেট : আসন্ন রমজান ও ঈদকে টার্গেট করে জাল নোট তৈরি চক্র ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তথ্যানুযায়ী বর্তমানে ঢাকাকেন্দ্রিক অন্তত ৩০টি সক্রিয় চক্র রয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও এ চক্রগুলো কোটি কোটি টাকার জালনোট বাজারে ছাড়ার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে। যদিও চলতি মাসেই র‌্যাব-পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে ৪টি চক্র। অপরাধী চক্র জাল টাকার ডিজাইন ও ছাপার কাজটি বরাবরই নিখুঁতভাবে করে আসছিল। টাকা ছাপানোর বিশেষ ধরনের কাগজ তৈরির ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা থাকলেও একটি দেশের বিশেষায়িত সংস্থা থেকে এই কাগজের জোগান দেওয়া হয় বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

সর্বশেষ খবর