রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিরাপত্তা পরিষদের সরাসরি হস্তক্ষেপ চাইল বাংলাদেশ

আজ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

বিরল এক সফরে বাংলাদেশে এসেছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সব স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের অংশগ্রহণে গঠিত প্রতিনিধি দল। গতকাল বিকালে তারা চার্টার্ড বিমানে সরাসরি কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছান। সন্ধ্যায় আলোচনা করেছেন রোহিঙ্গা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করা বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। এ সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকিসহ সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যাশা করা হয়েছে সংকট সমাধানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সরাসরি হস্তক্ষেপের। আজ সকালে প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে কথা বলবে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুতদের সঙ্গে। জানা যায়, বাংলাদেশে ও মিয়ানমারে পাঁচ দিনের সফরের উদ্দেশ্যে শুক্রবার নিউইয়র্ক থেকে রওনা দেয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যদেশের প্রতিনিধিরা। নিউইয়র্ক থেকে চার্টার্ড বিমানে কুয়েতে যাত্রাবিরতি শেষে গতকাল বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছায় ৩০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দল। দলে সদস্যদেশগুলোর পক্ষ থেকে জাতিসংঘে থাকা ১০ জন স্থায়ী প্রতিনিধি ও পাঁচজন উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি রয়েছেন। বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব মোহাম্মাদ খোরশেদ আলম। পরে তাদের নেওয়া হয় ইনানির হোটেল রয়েল টিউলিপে। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, নিরাপত্তা বাহিনী ও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনারের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রতিনিধিরা।

ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রের খবর, গতকাল সন্ধ্যায় হোটেল টিউলিপে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন এবং অস্থায়ী সদস্য বলিভিয়া, ইকুটোরিয়াল গিনি, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, কুয়েত, নেদারল্যান্ডস, পেরু, পোল্যান্ড, সুইডেন এবং আইভরি কোস্টের প্রতিনিধিদের ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সচিব মোহাম্মাদ খোরশেদ আলম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অনুবিভাগের মহাপরিচালক তারেক মাহমুদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং প্রথাগত ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি—এ তিনটি বিষয়ে আলাদা আলাদা ব্রিফিং করা হয়। তাদের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করে বাংলাদেশ। বলা হয়, এ সমস্যার মূল কারণ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে তাদের নাগরিকত্ব না থাকা। ১৯৭৮, ১৯৯২, ২০১২, ২০১৬, ২০১৭ সালে যা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। ফলে এর সমাধান একমাত্র মিয়ানমারই করতে পারে। সে জন্য এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে। সফরসূচি অনুসারে, আজ রবিবার সকাল ৯টা ২০ মিনিট থেকে বেলা ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুর কোনারপাড়া জিরো পয়েন্ট ও কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন তারা। এ সময় রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তারা রাখাইনে নির্যাতনের বর্ণনা শুনবেন। পরিদর্শন শেষে দুপুরে কুতুপালং ডি-ব্লকে সাংবাদিকদের প্রেস বিফ্রিং করার কথা রয়েছে। এরপর বেলা সাড়ে ৩টায় ঢাকার উদ্দেশে বিমানযোগে কক্সবাজার ত্যাগ করবেন তারা। এদিন ঢাকায় র্যাডিসন হোটেলে বিশ্রাম নেবে প্রতিনিধি দলটি। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের আয়োজনে এক সংবর্ধনায় অংশ নেবেন সদস্য প্রতিনিধিরা। আগামীকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হবে। পরে সকাল সাড়ে ১০টায় মিয়ানমারের উদ্দেশে বিমানযোগে ঢাকা ত্যাগ করবেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চপর্যায়ের এ প্রতিনিধি দল। সেখানে মিয়ানমার সরকারের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি তারা রাখাইনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হেলিকপ্টারে পরিদর্শন করবেন। অবশ্য সফরের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক ত্যাগের আগে প্রতিনিধি দলের নেতা নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা সুআদ্র জানিয়েছেন, রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি দেখার চেয়ে এ সফরে ভালো কিছু আর হতে পারে না।

রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন আশা করা যায় না : রাখাইনের পরিস্থিতি এখনো চরম উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেজ মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক। নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের আগে নিউইয়র্কে এক ব্রিফিং-এ তিনি এ মন্তব্য করেন। এ কারণে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন আশা করা যায় না বলেও এ সময় মন্তব্য করেন এই মুখপাত্র। তিনি বলেন, আমাদের মানবিকতা বিষয়ক সহকর্মীরা বলেছেন যে, এখনো রাখাইনের পরিস্থিতি চরম উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। উত্তর রাখাইন থেকে এখনো মানুষের দেশ ছেড়ে যাওয়ার রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু রিপোর্টে বলা হচ্ছে, তাদেরকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নির্যাতন হচ্ছে  মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর। স্টিফেন ডুজাররিক বলেন, পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর ও পরিত্যক্ত গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালিয়ে দেওয়ার প্রমাণ রয়ে গেছে। রাখাইনে এখন প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গার বসত আছে। তারা ভীষণ বৈষম্য ও একপেশে অবস্থায় আছেন। তাদের চলাচলের স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধতা আছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের অধিকার মারাত্মকভাবে সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মানবিক কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও টেকসই ফেরার আশা করা যায় না। এক্ষেত্রে রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ডুজাররিক বলেন, ওই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত জাতিসংঘ।

সর্বশেষ খবর