সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
আলোচনায় পর্ষদ সদস্যরা

ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে বেশি মজবুত ও শক্তিশালী

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে বেশি মজবুত ও শক্তিশালী। ব্যাংকটির আমানত কমেনি, বিনিয়োগও বন্ধ করা হয়নি। ব্যাংকটি সর্বশেষ ২০১৭ সালেও ২৪০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যার লভ্যাংশ সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররাও পেয়েছেন।

আর বর্তমানে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটি থেকে যাদের চাকরিচ্যুত (মূলত তারা পদত্যাগ করেছেন) করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যাংকটির বিনিয়োগ সুইচ বন্ধ করা হয়নি। গ্রাহকরা যেমন আমানত রাখছেন, তেমন ঋণও নিতে পারছেন আগের মতোই। এ ব্যাংকটি এখন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যাংক নয়। এটি সব ধর্মের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাংক। এখানে সব ধর্মের মানুষই চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালেও ব্যাংকটি আগের বছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত সংগ্রহ করেছে। এমন কি বর্তমানে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে যে ২১ জন সদস্য রয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই একেকটি ব্যাংক পরিচালনার মতো (চেয়ারম্যান হওয়ার) যোগ্যতা রাখেন বলে তারা মনে করেন। গতকাল বেসরকারি টিভি চ্যানেল নিউজটোয়েন্টিফোরের নিয়মিত আয়োজন “জনতন্ত্র গণতন্ত্র” অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং শীর্ষক আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন। এতে অংশ নেন ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল, ব্যাংকটির ইন্ডিপেনডেন্ট পরিচালক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর এফসিএ, শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির সদস্য মো. মুজাহিদুল ইসলাম চৌধুরী এবং উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আনোয়ার সাদী।মো. শাহাবুদ্দীন বলেন, এর আগে ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে মানুষের মাঝে একটা নেতিবাচক ধারণা ছিল, সেটা অমূলক ছিল না। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা বঞ্চিত হয়েছেন। যেমন চাকরির ক্ষেত্রে, আমানতের ক্ষেত্রে, ঋণের ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে। তখন তারা এক শ্রেণির মানুষকে আমানত রাখতে উৎসাহিত করেছেন, আবার সেই শ্রেণির মানুষকেই ঋণ দেওয়া হয়েছে। এখানে একটা রাজনৈতিক সংশ্লেষের অভিযোগ ছিল। এখন সে অবস্থা নেই। বঙ্গবন্ধু ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমরা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। এখন এখানে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই, বিশেষ করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। আগে এখানে নারীরা চাকরি পেতেন না, অমুসলিমরা চাকরি পেতেন না। এখন সব ধর্মের সব শ্রেণির মানুষজন এখানে বিনিয়োগ করতে পারছেন, ঋণ নিতে পারছেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে খোলাখুুলি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকরিও পাচ্ছেন। মোট কথা হলো, ইসলামী ব্যাংক নারীর ক্ষমতায়নেও কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী এসএমই খাতে মোট বাজারের ২১ শতাংশ ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ কয়েকজনকে চাকরিচ্যুতির যে খবর প্রকাশ হয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা হলো— তারা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন। এ জন্য তারা নিজেরাই পদত্যাগ করেছেন। তাদের কাউকেই চাকরিচ্যুত করা হয়নি। এমন কি চেয়ারম্যান আরাস্তু খান সরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে দু-একটি পত্রিকা যে দুটি কারণের কথা বলছে, তা ঠিক নয়। পর্ষদের নির্দেশনা সত্ত্বেও ২৬ জনকে চাকরিচ্যুত করেননি তৎকালীন চেয়ারম্যান আরাস্তু খান, এ তথ্যও ঠিক নয়। কোনো একটি বা দুটি বৃহৎ গ্রুপকে ঋণ না দেওয়ার মতো কোনো ঘটনাও ঘটেনি। এ জন্য কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। যে পাঁচজন চলে গেছেন, তারা সবাই পদত্যাগ করেছেন। সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ইসলামী ব্যাংকে এখন অন্য সব ধর্মের মানুষ বিনিয়োগ রাখতে পারেন। চাকরিও করছেন। এখানে আগে বিকৃত ধর্মের চর্চা ছিল, আমরা তা ধরিয়ে দিতে পেরেছি। আমরা এখানে একটা প্লাটফর্ম পেয়েছি। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল ধারণা হচ্ছে, এখানে যা হবে সবই বিনিয়োগ। আর এখানে টাকাকে বস্তু বেচাকেনার মাধ্যমের পরিবর্তে বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের শরিয়াহভিত্তিক যেসব ব্যাংক টিকে রয়েছে, এর মধ্যে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক হলো অন্যতম। এজেন্ট ব্যাংকিং বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, এখানে ১০৫টির অনুমোদন পাওয়া গেছে, ৯২টির কার্যক্রম চালু হয়েছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কেননা, এগুলো তো ব্যাংকের নিজস্ব কর্মকর্তারা পরিচালনা করেন না। ফলে খুব শিগগিরই বাকিগুলোর কার্যক্রম চালুর লাইসেন্স দেওয়া হবে।  ইসলামী ব্যাংকের তথ্যাদি তুলে ধরে তিনি বলেন, ব্যাংকটির ডিপোজিট ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছিল ২০১১ সালে। ২০১২ সালে ছিল ৪১ হাজার কোটি, ২০১৩-তে ৪৭ হাজার কোটি, ২০১৪-তে ৫৬ হাজার কোটি, ২০১৫-তে ৬১ হাজার কোটি, ২০১৬-তে ৬৮ হাজার কোটি এবং ২০১৭-তে এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকায়। একইভাবে বিনিয়োগের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১১ সালে ছিল ৩০ হাজার কোটি, ২০১২-তে ৩৭, ২০১৩-তে ৪০, ২০১৪-তে ৪৬, ২০১৫-তে ৫৩, ২০১৬-তে ৬১ এবং ২০১৭-তে বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকায়। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের কোনো বিনিয়োগ বন্ধ করা হয়নি। কয়েকটি পত্রপত্রিকায় ব্যাংকটির বিনিয়োগ সুইচ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, তা সঠিক নয়। এটা কোনো পানি বা গ্যাসের কল বা সুইচ নয় যে, হাত দিয়ে বন্ধ করে দেবেন। সুইচ বন্ধ করা হলে বিনিয়োগ ও আমানত বাড়ল কীভাবে? তারা ইসলামী শরিয়াহর কথা বলে গ্রামে-গঞ্জে একটি বিশেষ রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় ব্যাংকটিকে ব্যবহার করা শুরু করেছিল এবং পর্যায়ক্রমে তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। এমন কি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আগের পরিচালনা পর্ষদ নির্দিষ্ট কিছু লোককে ঋণ দিত এবং তাদের কাছ থেকেই আমানত নিত। এমন কি তাদের ৩০০ সংসদীয় আসনের জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিল। আমরা এসে তা বন্ধ করে দিয়েছি। জনগণের আমানতের অর্থ যেন যথাযথভাবে বিনিয়োগ হয়, বর্তমান পর্ষদ সে কাজই করে যাচ্ছে। এটাকে একটা চেইন অব কমান্ডে আনা হচ্ছে। আমরা ব্যবসাকে রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে চাই না।

হুমায়ুন কবীর এফসিএ বলেন, অধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সালের পর ইসলামী ব্যাংকের কোনো অর্থ সরাসরি ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে স্থানান্তর বা ব্যবহার করা হয়নি। দুটোই স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, এ জন্য দুটোর আয়-ব্যয় বিবরণীও পৃথক। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকে আমানত রেখে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমন কোনো উদাহরণ এখন পর্যন্ত নেই। এক্ষেত্রে কোনো কারণে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এ জন্য তিনি কোনো ধরনের গুজবে কান দিয়ে বিভ্রান্ত না হতে গ্রাহকদের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, কেননা ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান অন্য সব ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। ইসলামী ব্যাংক হাতেগোনা চার/পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে একটি, যারা ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাসেল-৩ এর আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। মো. মুজাহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য সাধারণ ব্যাংকের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো সুদের ব্যবসা আর বিনিয়োগ। ইসলাম বলছে, সুদ হারাম আর ব্যবসা হালাল। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল ধারাই হলো বিনিয়োগভিত্তিক ব্যবসা। যার মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ে, অর্থ প্রবাহ বাড়ে।

আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া বলেন, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে অর্থমন্ত্রীদের একটা সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে ইসলামী দেশের মধ্যে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আইডিবি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সূত্র ধরেই ১৯৮৪ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ গঠিত হয়। এই ব্যাংকে বর্তমানে সব শ্রেণির মানুষ রয়েছেন। সে সময় ব্যাংকটিতে আমানত ছিল মাত্র ১৫ কোটি টাকা। বর্তমানে এই ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় ব্যাংকের পলিসি থাকে— কখন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেবে, আবার কোন খাতকে অন্য সময় অগ্রাধিকার দেবে। ব্যাংকটি এখন দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি তারল্য সংকট সম্পর্কে বলেন, তারল্য সংকটের যে কথা বলা হচ্ছে, তাও ঠিক নয়। তারল্য সংকট কখন কোন অবস্থাকে বলবেন? ধরা যাক, কোনো গ্রাহক চেক নিয়ে গিয়ে টাকা না পেয়ে ফেরত আসছেন, এমন অবস্থাকে তারল্য সংকট বলা হয়। কিন্তু আমাদের ব্যাংকে তো এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তিনি আরও বলেন, ইসলামী ব্যাংকে স্কুল ব্যাংকিংয়ে আড়াই লাখ হিসাব রয়েছে। সব ব্যাংকের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। যারা ব্যাংকিং সেবা সম্পর্কে জানতেন না, তারা আমাদের পৌর বিনিয়োগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছেন এবং বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখছেন। ইসলামী ব্যাংক রেমিট্যান্স আহরণেও ব্যাংকগুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের শিল্পায়নের জন্য যে খাতটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে, অর্থাৎ যে গার্মেন্ট খাত, এ খাতেও ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি এবং সর্বপ্রথম। এ ছাড়া এসএমই খাতেও ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ শীর্ষে রয়েছে। এখানে সম্পদভিত্তিক বিনিয়োগকারী নেওয়া হয়। যারা এখানে আমানত রাখেন তাদের অংশীজন হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের সুদ না দিয়ে লভ্যাংশ দেওয়া হয়। আমানতকারী যে টাকা রাখেন তা দিয়ে আমরা বিনিয়োগ করি। সেখান থেকে যে লাভ হয়, সে লাভের একটা অংশ শেয়ারহোল্ডারদের দেওয়া হয়। সুদভিত্তিক প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে ব্যবসা করছে ইসলামী ব্যাংক। এখানে কেউ কখনো লোকসানের শিকার হবেন না। যারা এখানে আমানত রাখেন তাদের সংখ্যাও সোয়া কোটি।

সর্বশেষ খবর