রবিবার, ৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ওআইসি চুপ করে থাকতে পারে না

মুসলিম বিশ্বের দুরবস্থা কাটাতে শেখ হাসিনার পাঁচ দফা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

ওআইসি চুপ করে থাকতে পারে না

মুসলিম দেশগুলোর জোট ইসলামী সম্মেলন সংস্থাকে (ওআইসি) বিপন্ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিপীড়িত মানবতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। কাজেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন জাতিগত নির্মূলের মুখোমুখি, ওআইসি তখন নিশ্চুপ থাকতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও আমাদের সবার মতো মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার এবং জীবন-জীবিকার অধিকার রাখে। তাই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে ওআইসিকে অবশ্যই নেপিদোর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। গতকাল সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী ইসলামী সম্মেলন সংস্থার ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সভার (সিএফএম) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় মুসলিম বিশ্বের বর্তমান দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

সকালের এ অধিবেশনে বিশেষ অতিথি ছিলেন কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং ওআইসি মহাসচিব ইউসুফ এ ওথাইমিন। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে বক্তব্য দেন তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং ওআইসি সম্মেলনের সভাপতির প্রতিনিধি বেকির বোজড্যাগ, এশিয়ার পক্ষে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত ভাইস মিনিস্টার আবদুর রাহমান মোহাম্মাদ ফাসির, মধ্যপ্রাচ্যের পক্ষে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল বিন আহমেদ আল জুবায়ের এবং আফ্রিকার পক্ষে সেনেগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদকি কাবা বক্তৃতা করেন। এর আগে উদ্বোধনী সেশনের অন্যতম আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে রিপাবলিক অব কোটি ডে’লভয়রি (আইভরিকোস্ট)-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ৪৪তম সিএফএম’র সভাপতি মার্সেল আমন-তানোহ আয়োজক দেশ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে ৪৫তম সিএফএমের সভাপতিত্ব হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশ আগামী এক বছর এই প্লাটফর্মে সভাপতির দায়িত্ব পালন করবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবার আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিপীড়িত মানবতার জন্য আমরা আমাদের চিত্ত ও সীমান্ত দুই-ই উন্মুক্ত করে দিয়েছি। মিয়ানমারের প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের ব্যথায় ব্যথিত। কাজেই জোরপূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের মর্যাদা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমি ওআইসিকে তাঁদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।’ ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে ঢাকায় ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এমন একটা সময় অতিক্রম করছি যখন প্রযুক্তি প্রবাহ ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং যুব সমাজের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে অসমতা, অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক অবিচার এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব। এসবের সমন্বিত প্রভাবে আমাদের ইসলামী চিন্তা-চেতনার মৌলিক ভিত্তি আজ হুমকির সম্মুখীন। এমন অবস্থা আগে কখনো আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। তিনি বলেন, এখনকার মতো মুসলিম বিশ্ব আগে কখনো এত বেশি পরিমাণ সংঘাত, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, বিভাজন ও অস্থিরতার মুখোমুখি হয়নি। লক্ষ্য করা যায়নি এত ব্যাপক হারে বাস্তুহারা জনগোষ্ঠীর দেশান্তর। আজকে মুসলমান পরিচয়কে ভুলভাবে সহিংসতা ও চরমপন্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে পারে না। এখন সময় এসেছে আমাদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার। সময় এসেছে টেকসই শান্তি, সংহতি ও সমৃদ্ধির আলোকে আমাদের ভবিষ্যেক নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর। শেখ হাসিনা বলেন, ইসলামী বিশ্বের রূপকল্প এমন হতে হবে যাতে আমরা আমাদের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারি। নিজেরাই সব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধান করতে পারি। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের পথ আমাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ফলাফলকেন্দ্রিক নতুন কৌশল-সংবলিত একটি রূপান্তরিত ওআইসি। পরে ওআইসি মহাসচিব ইউসুফ এ ওসাইমিন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে পবিত্র কাবা শরিফের গিলাব উপহার দেন। এ ছাড়া ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম বৈঠক (সিএফএম) উপলক্ষে অনুষ্ঠানে স্মারক ডাক টিকিটও অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেন, উন্নয়ন আমাদের অধিকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আমাদের নাগালের মধ্যে এবং সামাজিক অগ্রগতির উপায় আমাদের হাতে। আমাদের এখন প্রয়োজন যৌথ ইসলামী কর্ম কৌশল ঢেলে সাজানো। এ জন্য এক, ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের ওপর সবাইকে আস্থাশীল হতে হবে। সাম্প্রদায়িক মানসিকতা বর্জন করতে হবে এবং ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা বা সমাজে বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশে ধর্মকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। দুই, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব বিবাদের সমাধান করতে হবে। আমাদের নিন্দুকদের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না দিয়ে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। ওআইসিতে আমাদের বিরোধ মীমাংসার প্রক্রিয়াসমূহকে শক্তিশালী করতে হবে এবং আমাদের নিজস্ব শক্তি ও সম্পদসমূহের আরও উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। তিন, আমাদের আত্মসচেতন আলোকিত জীবনযাপন করতে হবে। আমাদের মৌলিক বিশ্বাসকে অটুট রেখে আজকের আধুনিক সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে জীবনযাপন করতে হবে। তাহলেই ইসলাম-সম্পর্কিত ভীতি দূর হবে। আমাদের মূল্যবোধভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লালন করে আলোকিত বিশ্ব ব্যবস্থার পথ দেখাতে হবে। চার, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণ এবং জরুরি মানবিক দুরবস্থা মোকাবিলার জন্য ইসলামী সম্মেলন সংস্থার বলিষ্ঠ কর্মসূচিসহ একটি দ্রুত কার্যকর উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা আবশ্যক। ওআইসি-২০২৫ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাঁচ, ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধ যেমন শান্তি, সংযম, ভ্রাতৃত্ব, সমতা, ন্যায়বিচার ও সমবেদনা থেকে আমাদের সর্বদা অনুপ্রেরণা ও শক্তি আহরণ করতে হবে।

সবার কণ্ঠেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোর পদক্ষেপের দাবি : সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ওআইসি মহাসচিব, সেনেগালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তুরস্কের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রত্যেকেই উদ্বোধনী অধিবেশনে তাদের দেওয়া বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয়টি জোড়ালোভাবে তুলে ধরেন। বর্তমানে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই প্লাটফর্মের সভাপতি বাংলাদেশের পরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী তাঁর বক্তব্যে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গণহত্যার পরে এটিই সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়। ওআইসির উচিত হবে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করা। একই সঙ্গে মিয়ানমারকে রাজি করানো যাতে করে টেকসইভাবে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে পারে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বলেন, ‘রোহিঙ্গা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি আমাদের সবার সমস্যা। এই সমস্যা এখনো চলছে এবং আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এটি যেন বন্ধ হয়। যারা এ ধরনের মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের দায়বদ্ধতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়িত্ব নিতে হবে।

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির নৈশভোজ : সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর মধ্যাহ্নভোজ সেরেই রুদ্ধদ্বার ওয়ার্কিং সেশন শুরু করেন ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। প্রত্যেক প্রতিনিধি দলের প্রধান নিজ দেশের পক্ষে ওআইসির বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। পাশাপাশি ওআইসির সহকারী মহাসচিব পদে আলাদা কক্ষে ভোটও প্রদান করেন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি দলের প্রধানরা। পরে বিকালের শেষ ভাগে শুরু হয় অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা। ৬টা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিয়ে বিদেশি অতিথিরা চলে যান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নৈশভোজে অংশ নিতে। সাড়ে ৭টায় শুরু হওয়া নৈশভোজ দুই ঘণ্টা চলার পর নিজ নিজ হোটেল কক্ষে ফিরে যান ৫৭ দেশের প্রায় সাড়ে পাঁচশ প্রতিনিধি।

রোহিঙ্গা নিয়ে আজ বিশেষ অধিবেশন : আজ সকাল ৯টায় রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলো যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তা নিয়ে বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। এই অধিবেশনে আগ্রহী সব প্রতিনিধির অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকছে। পরে দুপুরে নিজেদের মধ্যে শেষ মুহূর্তের আলোচনা শেষে প্রস্তাবনা ও ঢাকা ঘোষণা গ্রহণ করা হবে। বিকালে সম্মেলনের শেষ আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিবেন বর্তমান সভাপতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ওআইসি মহাসচিব। আগামীকাল বেশিরভাগ প্রতিনিধির ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে।

ভোটে হারল বাংলাদেশ : ওআইসি পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সম্মেলনে এশিয়া মহাদেশ থেকে সহকারী মহাসচিব পদে হওয়া ভোটে হেরে গেছে বাংলাদেশ। ১৮ ভোটারের এই ভোটে ১২ ভোট পেয়ে জিতেছেন কাজাখস্তানের প্রার্থী আসকার মুসিনোভ। ৬ ভোট পেয়েছেন বাংলাদেশের হয়ে নির্বাচনে লড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) কামরুল আহসান। ওআইসির ভোটার ছিল বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ইরান, সুরিনাম, গায়ানা, আলবেনিয়া, কাজাখস্তান, আজারবাইজান, কিরগিজ রিপাবলিক, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান।

সর্বশেষ খবর