শিরোনাম
রবিবার, ৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
ভিন্ন চিন্তা

এই গল্প সবাইকে শুনতে হবে

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

এই গল্প সবাইকে শুনতে হবে

কীভাবে দুটো রাষ্ট্র অলিম্পিকে খেলতে গিয়ে এতটা কাছাকাছি চলে এলো। শত্রুতা আজকের নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কোরিয়া আলাদা দুটি দেশ হয়ে গেল। উত্তরটি অধিকার করল রাশিয়া এবং দক্ষিণটি আমেরিকা। আজ উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিং জন উন, যিনি কিম জং ইলের সন্তান, অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় আছে গণতন্ত্র, যেখানে মুন জা ইন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। ২০১৫ সাল থেকে পৃথিবী লক্ষ্য করছে এই দুই দেশকে। কখনো যুদ্ধের দিকে প্রবাহিত এমনভাবে যেন মনে হচ্ছে এখনই আণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। যেমন জাপান এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে দুটো মিসাইল ছুটে গেল। ভালো খবর এলো খেলাধুলার ক্ষেত্রে। দক্ষিণ কোরিয়া বলল, শীতের অলিম্পিক গেমস তাদের দুই দেশকে কাছে নিয়ে আসতে সহায়তা করবে। কিং জন উন বললেন, খেলাধুলার মাধ্যমেই আমরা একে অপরের কাছে আসতে পারব সহজেই। ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া পাঠাল তাদের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়, গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, অপেরাশিল্পী এবং তরুণ নেতাদের যারা পারবে দুই দেশের শীতল আবহাওয়াকে খানিকটা সৌন্দর্যের দিকে প্রবাহিত করতে। কী সুন্দর এ পরিকল্পনা। আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই। এটা তো আমারই পরিকল্পনা। আমরাই আসতে পারি একে অন্যের কাছে গান গেয়ে, খেলাধুলায়, অভিনয়ে, নাটক পাড়ায়, কবিতা পাড়ায়, কারণ আমরা যে একই মানুষ। রাজনীতিকরা এটা সম্পূর্ণ ভুলে বসে থাকেন। নতুন কোরিয়ার দুই পাশেই আছে নতুন নাগরিক যারা শান্তি চায়, যারা খোলা গলায় গান গাইতে চায়, যারা মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। অলিম্পিক গেমসে শুরু হলো উত্তর কোরিয়া আর দক্ষিণ কোরিয়ার মিলন গীতির প্রথম সূত্র। মেয়ে হকি খেলোয়াড়রা তাদের সুন্দর জার্সি পরে একে অপরের সঙ্গে হকি খেললেন। কে জিতল তা বড় কথা নয়। জিতল বন্ধুত্ব, জিতল তরুণদের মধ্যে নতুন ভালোবাসার স্পর্শ। মানবতার মধ্যে বিরাজ করে একত্বের অনুভূতি। কেউ কাউকে মেরে ফেলব তা তরুণরা কখনই ভাবে না। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ছেলে উত্তর কোরিয়ার একটি মেয়েকে সহজেই জয় করে নিল। তেমনি উত্তর কোরিয়ার একটি ছেলে সহজেই তার হৃদয়কে মেলে ধরল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ছেলের সঙ্গে। এটাই  সহজ প্রক্রিয়া। এটাই আসল মনুষ্যত্ব। কিং জন উন নিজেই তরুণ। তিনি ভাবলেন এই ভালোবাসা কোথায় লুকিয়ে ছিল? মুন জা ইন স্বীকার করলেন যে আমেরিকার সঙ্গেও এই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এর পরেই আসল ঝড়ের পূর্বাভাস। সবাই ভুলে গেল উত্তর, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় কথাবার্তার কথা। আমেরিকা কখনো চায়নি এই মিল হোক। কিম জং উনের ভগ্নি এই মিলনের বিরুদ্ধ শক্তি। তিনি অনেক চেষ্টা করলেন যাতে মিল না হয়। কিন্তু খেলাধুলার এমনই শক্তি যে ভগ্নি কিছুই করতে পারলেন না। খেলাধুলা এগিয়ে গেল। বন্ধ হলো না। সবচেয়ে ভালো খবর এলো মাত্র গতকাল। অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে টাটকা খবর। কলম নিয়ে বসলাম পাঠক-পাঠিকাদের জন্য। আমি মিলনের সপক্ষে। গান গাই, তাই মিলনের ডাক সবচেয়ে আগে শুনতে পাই। শুক্রবার দিন উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা যে সমঝোতায় পৌঁছেছেন তার বিশদ বিবরণ ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’ কালই ছাপা হয়েছে। যাতে লেখা হয়েছে ‘পানমুনজন ডিক্লেয়ারেশন’ হচ্ছে শান্তির সপক্ষে, উন্নয়নের সপক্ষে এবং সর্বশেষ দুটি দেশ একত্রকরণের সপক্ষে। দুটি দেশের মানুষ ৫০ বছরের বেশি আলাদা। তারা একই মানুষ, একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, শুধু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তাদের আলাদা করে দিয়েছে। এক নম্বর শর্তে বলা হয়েছে ১. উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ আবার রক্তের সম্পর্কে একত্রিত হবে, তারা শান্তির সপক্ষে দুই দেশের মানুষকে আবার এক করবে। দুই দেশের মানুষকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে মিলনের লক্ষ্যে। ২. তাদের কথাবার্তা চলতেই থাকবে সব পর্যায়ে। ৩. যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই লক্ষ্যে যুক্ত লিয়াজোঁ অফিস তৈরি হবে। ৪. সাধারণ মানুষকে চলাচলের অধিকার দিতে হবে। ৫. মানবিক কাজগুলো করতে হবে দ্রুত। এমনই আরও অনেক ক্ষেত্রে দুটি দেশ কীভাবে এক হতে পারে তার কথা বলা হয়েছে। আমার দৃষ্টি অন্যত্র। দুই জার্মানি আমাদের চোখের সামনে এক হয়ে গেল। কোরিয়া এক হতে চলেছে, আজ না হয় কাল। পাঞ্জাব হয়নি, বাংলা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ১৯০৫ সালে ‘বাংলার বায়ু, বাংলার মাটি, বাংলার জল, এক হোক এক হোক হে ভগবান’। তার বাণী সত্য হয়নি। বাংলা বিভক্ত হয়েছে। আমরা পাকিস্তান পেয়েছি, পেয়েছি নতুন বাংলাদেশ। সবদিক থেকে মুসলমানরা জেগে উঠেছে নতুন পতাকার তলে। অন্তত যাতায়াতের ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, মানসিকতার ক্ষেত্রে, দুই বাংলাকে আমরা আরও কাছে টানতে পারি। এতে কোনো ক্ষতি নেই। রান্নাঘর আলাদা। সেটি আর এক হবে না। কাদের স্বার্থে আমরা অপরিচয়ের বন্ধনে আরও কয়েক শতাব্দী কাটিয়ে দেব? কাদের ভুলে আমরা বাঙালিরা মুখ ঘুরিয়ে নেব? এই প্রশ্ন আজ না হলেও কাল মানুষের মনে জাগবে। ধর্ম আমাদের সমুন্নত করবে, আলাদা করবে না। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আমরা ভালোই ছিলাম। কতিপয় রাজনীতিক স্বার্থান্বেষী আমাদের ভুল বুঝিয়েছে। গতকাল জার্মানিতে যা হয়েছে, আজ কোরিয়ায় যা হতে চলেছে, তা থেকে আমাদের কিছুটা শিক্ষা নিতে দোষ কী? কাঁটাতারের বেড়া, যেখানে এখনো ঝুলে তরুণীর লাশ, আল মাহ্মুদের কবিতায়। আরও কয়েকটি শতাব্দীর প্রয়োজন হবে কী? এটাই মানবতা? এটাই বন্ধুত্ব? এ পর্যন্ত প্রায় হাজার খানেক বাংলাদেশি পাঞ্জাব দেশীয় রাইফেলধারীদের গুলিতে জীবন দিয়েছেন এই সীমান্তেই। আমরাও দিয়েছি ত্রিশ লাখ জীবন, ওই পাঞ্জাবিদের গুলিতেই। রবীন্দ্রনাথের গান গাই, নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করি, সুকান্তকে বুকে নি, শামসুর রাহমান, আল মাহ্মুদের অনুসারী যারা, তাদের বক্ষে এই গুলি প্রবেশ করে প্রত্যক্ষভাবে। কোথায় আমাদের অমিল? কোথায় আমাদের দৈন্য, আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। জার্মানিতে গিয়েছি। সবাই মিলেমিশে একাকার। ‘বার্লিন ওয়াল’ এখন মিউজিয়াম। কলকাতায় ’৪৭-এর রায়ট প্রত্যক্ষ করেছি, দেখেছি মন্বন্তর, দেখেছি পায়ে হেঁটে হাজার হাজার মানুষের দেশত্যাগ। কার স্বার্থে? মানবতার? হতেই পারে না। যারা মিলনের গান গেয়েছেন, যেমন নজরুল, তাদের গানগুলো যখন গাই, তখন চোখে পানি আসে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারি না। সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নয়। ধর্ম হলো সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরা। লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর