বুধবার, ১৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

পদদলনের আগে করা হয় লাঠিচার্জ, গ্রেফতার চার

সাতকানিয়া ট্র্যাজেডি

মুহাম্মদ সেলিম, সাতকানিয়া থেকে ফিরে

পদদলনের আগে করা হয় লাঠিচার্জ, গ্রেফতার চার

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়ায় শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কবির স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিলস লিমিটেড’ (কেএসআরএম)-এর ইফতারিসামগ্রী ও টাকা বিতরণের সময় প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। এ সময় কেএসআরএম’র নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীরা চাপ কমাতে লাঠিচার্জ করে। তাদের লাঠিচার্জের আঘাত এড়াতে নারীরা দৌড়ে সরে যাওয়ার সময়ই পদদলনের ঘটনা ঘটে। এ পদদলনের ঘটনায় শিশুসহ ১০ নারী নিহত এবং কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। গতকাল সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের কাদেরিয়া মঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানার মাঠে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার নারীদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য জানা যায়। এদিকে সাতকানিয়ার নলুুয়ায় পদদলনের ঘটনায় কেএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাজান মিয়াসহ অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। গতকাল সকালে নিহত হাসিনা আক্তারের স্বামী মো. ইসলাম বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

সাতকানিয়া থানার ওসি রফিকুল হোসেন বলেন, ‘ইফতার বিতরণ আয়োজনে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি রয়েছে। তাদের কিছু ত্রুটি রয়েছে।’ এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে সোমবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ দাবি করে ইফতারি বিতরণের সময় তীব্রচাপ ও হুড়াহুড়িতে হিটস্ট্রোক করে ১০ নারী মারা যায়। ইফতারি বিতরণের সময় ১০০ পুলিশ ও নিজস্ব ২০০ স্বেচ্ছাসেবী ছিল। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ। আহত হয়ে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন লোহাগাড়া উপজেলার রোকেয়া বেগম (৪০)। তিনি সোমবারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘সকালে হাজার হাজার নারী একসঙ্গে ইফতারসামগ্রী ও টাকা নিতে মাঠে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় লাঠি নিয়ে কয়েকজন যুবক আমাদের আঘাত করতে থাকে। তাদের কয়েকটি আঘাত আমার মাথায় লাগে। এরপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি।’ চিকিৎসাধীন সাতকানিয়া উপজেলার হোসনে আরা (৪৫) বলেন, ‘কিছু ছেলে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। কয়েকজন মেয়ে আমার ওপর এসে পড়ে। মেয়েদের পায়ের চাপে আমার কোমর ভেঙে যায়।’ অনেকটা অভিন্নভাবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন চিকিৎসাধীন নুর আয়েশা (৫০) ও রাজিয়া খাতুন (৫০)। সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার সাদিয়া তাবাচ্ছুম বলেন, ‘যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের সবাই পদদলনের কারণেই আহত হয়েছেন। বর্তমানে যে চারজন চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে চমেক হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে’। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নলুয়া এলাকার এক অধিবাসী বলেন, ‘প্রতি বছর ইফতারি বিতরণের জন্য স্থানীয় লোকজনদের নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু এবার নিজস্ব সিকিউরিটিদের ইফতারি বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাদের এ দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা ছিল উগ্র স্বভাবের। তাদের কারণেই এ ঘটনা ঘটে।’

সরেজমিন ঘটনাস্থলে : গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। কাদেরিয়া মঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানার মাঠের পূর্বপাশে গেটে রয়েছে অসংখ্য নারীদের ফেলে যাওয়া জুতা। অনেক লোকের সমাগম থাকলেও কেউ কথা বলছেন না। যে কয়েকজন কথা বলেছেন, তারা নিজের পরিচয় গোপন রেখে মুখ খুলেছেন। তবে কয়েকজন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা কেএসআরএমের গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ ছিলেন। এদেরই একজন আলমগীর মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান আয়োজনের তদারককারী দাবি করে বলেন, ‘হিটস্ট্রোকের কারণেই ওই নারীরা মারা যান। এ নিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট হলে ভবিষ্যতে কেএসআরএম গ্রুপ এভাবে দান-খয়রাত বন্ধ করে দেবে।

মামলা দায়ের : সাতকানিয়ার নলুুয়ায় পদদলনের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। গতকাল সকালে নিহত হাসিনা আক্তারের স্বামী মো. ইসলাম বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন। আমাদের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া প্রতিনিধি এ কে আজাদ বলেন, ‘গতকাল সকালে কেএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাজান মিয়াসহ অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে মামলা করা হয়। সাতকানিয়া থানার উপ-পরিদর্শক রেখা প্রভা দে বলেন, ‘অভিযোগটি গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।’

ঘর মেরামতের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হাসপাতালে : লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর কলাউজান গ্রামের মৃত মনির আহমদের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। স্বামী মারা যাওয়ায় এখন এক সন্তান নিয়ে যে ঘরে বাস করেন সে ঘরের অবস্থা নাজুক। ঘরটি মেরামত করতে টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা জোগাড় করতে যান ইফতারসামগ্রী ও টাকা আনতে। টাকা জোগাড়ের বদলে উল্টো পদদলিত হয়ে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেডে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, সোমবার সকালে সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়ায় কেএসআরএমের ইফতারসামগ্রী ও টাকা বিতরণের সময় পদদলনের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় শিশুসহ ১০ নারী নিহত এবং কমপক্ষে ২০ নারী আহত হয়েছেন।

চারজন গ্রেফতার : এদিকে, যাকাত ও ইফতার সামগ্রী সংগ্রহের সময় পদদলিত হয়ে নারী-শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল  বিকালে কেএসআরএম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বাড়ির পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- সাতকানিয়ার মক্কার বাড়ির ছিদ্দিক আহমদের ছেলে মুরিদুল আলম প্রকাশ মুরাদ (২৭), পূর্ব গাটিয়াডাঙ্গার জাকির হোসেনের ছেলে মো. ইদ্রিছ (২৬), আমিলাইশ এলাকার সোলায়মানের ছেলে হাবিব আহমদ সাহেদ (৩২) এবং হাঙ্গরমুখ (খন্দকার পাড়া) এলাকার মো. ইদ্রিছের ছেলে আজগর আলী (২৮)। সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হোসেন বলেন, ‘যাকাত ও ইফতার বিতরণের সঙ্গে জড়িত ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর