বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি বাণিজ্য

মাহবুব মমতাজী

সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি বাণিজ্য

ভবন, স্থাপনা, যন্ত্রপাতি ও লোকবল সবই সরকারের। কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে। সরকারি হাসপাতালে থেকেই বাণিজ্য করে নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানেই না বিষয়টি সম্পর্কে। ঘটনাটি খোদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। এখানে এসে হাসপাতালের নতুন ভবনে দেদার ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন অন্তত ৫টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রতিনিধিরা। শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও চলে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মরতদের বেসরকারি বাণিজ্য। গতকাল ঢামেক হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ এবং মেডিসিন ওয়ার্ডে দেখা গেছে আউটডোর ও ইনডোরের রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। নতুন ভবনের সাত তলায় ৭০৩ ওয়ার্ডে বিচ্ছুর কামড়ে ভর্তি হওয়া আবদুর রউফের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন চানখাঁরপুল জেনারেল হাসপাতালের  এক প্রতিনিধি। এর আগে গত ৩ মে ডেমরার আবদুল মালেক সিবিসি ও আরবিএস পরীক্ষা করাতে ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের উল্টো দিকে প্যাথলজি সেন্টারে আসেন। তার বয়স আনুমানিক ৪৩। সেখানে সিবিসি পরীক্ষার জন্য টিকিট দিলেও কাউন্টার থেকে তাকে জানানো হয়— এখানে আরবিএস পরীক্ষা হয় না। এটা বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হবে। তাত্ক্ষণিকভাবে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের আমেনা নামের এক নার্স তাকে বাইরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আমেনা মোবাইল ফোনে নীলা নামে একজনকে ডেকে আনেন। তিনি হোসনি দালান রোডের পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রতিনিধি। সব সময় নীলার ভ্যানিটিব্যাগে সিরিঞ্জ, পাইপ, টেলিস্কপ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের ইনস্ট্রুমেন্ট থাকে। মালেকের সঙ্গে নীলার যোগাযোগ করিয়ে দেন আমেনা। রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের রোগীদের বসার স্থানেই আরবিএস পরীক্ষার জন্য মালেকের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন নীলা। পরীক্ষার ফি বাবদ নেন ৭০০ টাকা। পরেরদিন পরীক্ষার রিপোর্ট নার্স আমেনার কাছে দিয়ে যান তিনি। সেখান থেকে রিপোর্টটি সংগ্রহ করেন মালেক। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এদিন মালেকের মতো ভোগান্তির শিকার হন খাদিজা ও তুহিন নামে আরও দুই রোগী। তারা সিবিসি ও আরবিএস দুটি পরীক্ষাই করান নীলার কাছে। প্রতিদিন নীলা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ১৫-২০ জন রোগী পান। গত ২৫ এপ্রিল আবদুল মালেক ঘাড়ের সমস্যার জন্য ঢামেক হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। তার চিকিৎসাপত্রের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ১৪১৩৪/১১৪। চিকিৎসাপত্রে চিকিৎসক ওষুধ ছাড়াও কয়েকটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা দেন। এর মধ্যে ছিল সিবিসি, এমআরআই ও আরবিএস। ওইদিনই তিনি দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে এমআরআই পরীক্ষা করান। এসব স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঢামেকে হয় কিনা জানতে হাসপাতালটির উপ-পরিচালক ডা. বিদ্যুৎ কুমার পালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এখানে এসব পরীক্ষার সুব্যবস্থা আছে। তবুও কেন বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধিদের ডেকে এনে এ হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি গতকাল বলেন, এ ধরনের দু-তিন দিনের একটি গ্যাপ আছে। আমাদের রি-এজেন্ট ঠিকমতো সাপ্লাই দিতে পারছে না। কিন্তু ১৫ দিন ধরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন সরকারি হাসপাতালে এসে কীভাবে বাণিজ্য করছে তা আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডের ম্যানেজার তানজিব আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা কোনো রোগীকে জোরজবরদস্তি করি না। যারা স্বেচ্ছায় করাতে চান তাদের পরীক্ষাই করি। শুধু আমরাই না, ঢাকা মেডিকেলে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ কাজ করছে। অভিযোগ রয়েছে, শুধু প্যাথলজি সেন্টারেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনের বাণিজ্য সীমাবদ্ধ নয়। তাদের বাণিজ্য ওয়ার্ডেও বিস্তার লাভ করেছে। সেখানে ভর্তি রোগীদের বেডে গিয়েও স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে বাণিজ্য করে নিয়ে যাচ্ছে ক্লিনিকগুলো। মেডিসিন বিভাগের ৭০১, ৭০২ ও ৭০৩ নম্বর ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক তৎপরতা চলে। ৭০৩ নম্বর ওয়ার্ডের বয় নুরুল ইসলাম (৫৫) নার্স ও ইন্টার্নি চিকিৎসকদের যোগসাজশে ক্লিনিকগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। এ বিষয়ে একজন নার্সের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এটি ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবেন।’  এই ওয়ার্ডে দায়িত্বরত আক্তারুজ্জামান নামে এক আনসার সদস্য জানালেন, এখানে সব স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা আশপাশের ক্লিনিকের লোকজন এসে করেন। বিনিময়ে গলাকাটা দাম নেন। জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছাকাছি অবস্থিত বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে হোসনি দালান রোডে পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেড, চানখাঁরপুল জেনারেল হাসপাতাল, চৌধুরী ক্লিনিক, রাফাত জেনারেল হাসপাতালের মৌসুমি ক্লিনিক ও সেবা মেটারনিটি নামের প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। শুধু ঢাকা মেডিকেলেই নয়, দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আশপাশের ক্লিনিকগুলোর বাণিজ্যে জড়িত প্রতিষ্ঠানটিরই চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর