বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ধান কাটার উৎসবে বজ্রপাত আতঙ্ক

জুলকার নাইন, গাইবান্ধা থেকে

বোরোর বাম্পার ফলনে উত্তরাঞ্চলজুড়ে চলছে ধান কাটার উৎসব। উৎসবে মুখরিত এ অঞ্চলের প্রতিটি গ্রাম। কয়েক সপ্তাহ আগেও যেখানে মাঠে মাঠে শোভা পাচ্ছিল সবুজের সমারোহ, এখন সেখানে সোনালি রঙের ছড়াছড়ি। সময় হয়েছে ঘরে তোলার। তাই ব্যস্ততম সময় পার করছেন কৃষকরা। যেন দম ফেলার সময়ও নেই তাদের। কিন্তু এরই মাঝে আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয়েছে বজ্রপাত এবং ধান কাটার শ্রমিকের তীব্র সংকট। বাড়তি মজুরি দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না দিনমজুর। ফলে মাঠ থেকে ধান কেটে মাড়াই করে ঘরে তুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে কৃষককে। গত কয়েক দিন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। যতদূর চোখ যায় শুধু সোনালি আভা ছড়ানো ধানের শীষ। মাঝেমধ্যেই কিছু পরিমাণ আধা পাকা ধানের শীষের সমারোহ। কিছু খেতের ধান ইতিমধ্যেই কেটে নিয়েছেন কৃষক। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, নানা শঙ্কা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এ বছর সারা দেশে বোরো ধানের রেকর্ড বাম্পার ফলন হয়েছে। তাদের প্রত্যাশা, বৃষ্টি কিংবা শিলাবৃষ্টি সত্ত্বেও এবার প্রথমবারের মতো দেশে বোরোর উৎপাদন দুই কোটি টনে গিয়ে দাঁড়াবে। কারণ শিলাবৃষ্টিতে ফসলের সামান্য ক্ষতি হয়েছে। বিপরীতে সারা দেশে বোরো আবাদের আওতা এবং উৎপাদন বেড়েছে। ফলে বড় কোনো দুর্যোগ না হলে এবার মোট বোরোর ফলন দুই কোটি টনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। এটি হবে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে রেকর্ড। কৃষকরা বলছেন, আগাম বৃষ্টি না হওয়ায় ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি। পাশাপাশি খেতে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণও কম ছিল। এ ছাড়া এবার ফসলের খেতে সময়মতো পানি ও সার দিতে পেরেছেন তারা। মূলত এসব কারণে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। গাইবান্ধার কৃষি কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর জেলার সাত উপজেলায় এক লাখ ৩০ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক চাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে চালের উচ্চ মূল্যই কৃষকদের বোরো আবাদে আকৃষ্ট করেছে। গত দুই মৌসুমেই ধানের দাম বেশি থাকায় তারা এবার কোনো জমিই পতিত রাখেনি। কারণ আলুর চেয়ে এখন ধান বেশ লাভজনক। তাছাড়া বিদ্যুতের সরবরাহ ভালো থাকার কারণে কৃষকরা সঠিক সময়ে জমিতে সেচ দিতে পেরেছে। সার ব্যবস্থাপনাও ছিল পর্যাপ্ত। জমিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ ছিল না বললেই চলে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে থাকা হাসির ঝিলিক শ্রমিক সংকটে মলিন। সেই সঙ্গে কালবৈশাখীর সঙ্গে মুষলধারায় বৃষ্টিপাতে মাঠের পাকা ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কষ্টের ফসল ঘরে তুলতে না পারার শঙ্কায়ও ভুগছে অনেকে। শ্রমিকের তীব্র অভাবের মধ্যে নিরুপায় হয়ে উচ্চ মজুরিতে শ্রমিক নিতে বাধ্য হলেও চাহিদার পরিমাণ শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।

গাইবান্ধার মাঠের হাটের কৃষক আবদুল করিম জানান, শ্রমিক মিললেও একরপ্রতি মজুরি দিতে হচ্ছে কমপক্ষে ১২ হাজার টাকা। দিনমজুরি হিসেবে ৫০০-৬০০ টাকার সঙ্গে দিতে হচ্ছে দুই বেলা খাবার। তাও পাওয়া যায় না। একই জেলার আরেক কৃষক জাহানারা বেগম জানান, শ্রমিক সংকটের মধ্যেও কিছু শ্রমিক পাওয়া গেলে তারা কৃষকদের উল্টো নানা শর্ত জুড়ে দেয়। তারপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধান কেটে শ্রমিকরা খেতেই রেখে দিচ্ছে। সেখান থেকে আলাদা শ্রমিক দিয়ে বাড়িতে কাটা ধান এনে মাড়াই করতে হচ্ছে। আর বম মেশিন দিয়ে মাড়াই করতে প্রতি একরে লাগছে ১৫-১৬শ’ টাকা। তার ওপর আবার বজ্রপাত তৈরি করেছে আরেক আতঙ্ক। আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখলেই মাঠে আর কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ আগে বৃষ্টির মধ্যেও ধান কেটে ঘরে আনা গেছে। দেখা গেল, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার এক স্থানের শ্রমিককে আরেক স্থানে গিয়ে ধান কাটতে। উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগের একটি সংযোগস্থল পলাশবাড়ীতে কথা হয় শ্রমিক মিলন, শাহেদ, হাবিব, আক্কাসদের সঙ্গে। বাড়ি দিনাজপুর হলেও তারা কাজ করতে যাচ্ছেন অন্য অঞ্চলে। তারা জানান,  দিনাজপুরের ধানি জমির ধান কাটতে বিঘায় ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা দেয়। কিন্তু সান্তাহারে বিঘায় ৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পাই। সেখানে বেশি পেলে আমরা যাব না কেন! আরেকজন জানান, মৌসুমের শেষের দিকে নওগাঁ, নাটোরে বিঘায় আরও পাওয়া যায়। তখন আমরা সেখানে যাব। তবে গত মৌসুম থেকে ‘বজ্রপাতকে জমের মতো’ ভয় পাচ্ছেন উল্লেখ করে শ্রমিক আক্কাস জানান, এবার মনে হচ্ছে আরও বেড়েছে। আমার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দিনাজপুরে আরেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তখন থেকেই মনে ভয় বাসা বেঁধেছে বলে জানান শ্রমিক আক্কাস।

সর্বশেষ খবর