রবিবার, ২০ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাড়া-মহল্লায় নতুন গ্যাংস্টার

চাঁদাবাজিসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িত, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়া

মির্জা মেহেদী তমাল ও মাহবুব মমতাজী

পাড়া-মহল্লায় নতুন গ্যাংস্টার

হঠাৎ করে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে রাজধানীর গ্যাংস্টার। ঈদ সামনে রেখে পাড়া-মহল্লায় নিত্যনতুন গ্যাংয়ের জন্ম নিচ্ছে। জড়াচ্ছে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধে। নামে-বেনামে অসংখ্য গ্যাং বা চক্র গড়ে উঠেছে। এরা শুরুতে ফ্যাশন, ফ্যান্টাসিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধে। বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রচ্ছায়ায় এসব কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে এড়া। অনেকেই ব্যবহূত হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের হাতিয়ার হিসেবে। প্রতিনিয়ত ছিনতাই, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত ঘটছে এদের হাতে। রমজান শুরু হতে না হতেই বাড়িওয়ালা, মার্কেটের ব্যবসায়ী, ফুটপাথের দোকানদার ও ইফতার বাজারের বিক্রেতাদের ঈদ বকশিশের নামে চিরকুট পাঠানো শুরু করেছে গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা। তাদের তৎপরতায় জনসাধারণ অতিষ্ঠ হলেও নির্বিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, ভ্যা-ভ্যা শব্দে মোটরসাইকেল রেস, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব আবার এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে খুনখারাবি করতেও দ্বিধা করে না গ্যাংস্টাররা। মাঝে কিছুদিন দমে গেলেও রমজানে বিভিন্ন এলাকায় বখে যাওয়া কিশোরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে নগরবাসী। বিভিন্ন বাসাবাড়ির বাসিন্দাদের কাছে এরা ‘সাহরি পার্টি’ নামেও পরিচিত হয়ে আসছে। ভয়ঙ্কর এসব কিশোরের ভয়ে অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। ফলে বাড়িয়ে দিয়েছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের উদ্বেগ। জানা গেছে, বখে যাওয়া এসব কিশোরের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তবে তাদের নেপথ্যে থেকে মদদ দিচ্ছেন মহল্লার একাধিক রাজনৈতিক বড় ভাই। যে কোনো ধরনের অপকর্মে এদের বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা নেই। হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংসতাও ঘটাচ্ছে তারা অবলীলায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেদের কর্মকাণ্ডের খবর। রাস্তায় তুমুল বেগে গাড়ি, মোটরসাইকেল চালানো, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করছে তারা। এরা পাড়া-মহল্লায় গ্রুপ বেঁধে চলাফেরা করে। স্কুল-কলেজের মেয়েদের দেখলেই মেতে ওঠে ইভ টিজিংয়ে। আবার অনেক ভুক্তভোগী আদালতকেন্দ্রিক হয়রানি এবং নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মামলা করতেও ভয় পান। সূত্র বলছে, রাজধানীর উত্তরা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, আদাবর, পুরান ঢাকা, মতিঝিল, কাকরাইল, মগবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এসব বখে যাওয়া কিশোরের বিচরণ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, র‌্যাব-পুলিশের বিশেষ নজরদারি না থাকায় বখে যাওয়া কিশোররা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এদের বেশির ভাগই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। রাজধানীর উত্তরায় কাঁকড়া গ্রুপ, জি ইউনিট, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কে নাইট, ফিফটিন, ডিসকো বয়েস, নাইন স্টার, নাইন এম এম বয়েজ, পোঁটলা বাবু, সুজন, আলতাফ, ক্যাসল বয়েজ ও ভাইপার; পাওয়ার বয়েজ, ডি জে বয়েজ, জি স্টার, ফোর সি ভি বয়েজ, সেভেন স্টার, ব্ল্যাক, কিং নাইন, দাদা বয়েজ, রেড লাইট, প্রাণ টি এম সিসহ অন্তত ৩০টির মতো গ্যাংস্টার গ্রুপ এখনো সক্রিয়। উত্তরার বিভিন্ন বাড়ির দেয়ালে এসব গ্যাংয়ের নাম বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা দেখা যায়। তেজগাঁওয়ের প্রতিটি দলে চার-পাঁচ জন থেকে ১০-১২ জন করে সদস্য রয়েছে। ডেডলি রকার্স, কে ইউ, এস কে ৩০, ই এস ১৩, পিপিসহ বিভিন্ন নামের গ্রুপগুলো ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। স্টেশন রোড থেকে তেজকুনী বাজার পর্যন্ত এবং নাখালপাড়া, পলিটেকনিক কলেজেও দেখা দিয়েছে এই গ্যাংস্টার গ্রুপের আনাগোনা। মোহাম্মদপুরেও উঠতি বয়সী ১৩টি কিশোর অপরাধী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে বিহারি ক্যাম্পকেন্দ্রিক সাতটি গ্রুপ দাপিয়ে বেড়ায় পুরো মোহাম্মদপুর। এখানে বেশির ভাগ গ্রুপই চলে ব্যক্তির নামে। মিরপুর ও রমনায়ও দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করেছে বখে যাওয়া কিশোররা। মিরপুর ও রমনায় অন্তত ১৫টি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার ওয়ারী এবং গুলশান, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায়ও নানা অজুহাতে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। মহাখালী, দক্ষিণপাড়া, সাততলা বস্তি, কড়াইল বস্তি ও আশপাশ এলাকায় শতাধিক কিশোর এবং গ্যাংস্টারের সদস্যের দৌরাত্ম্যে বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। শাহজাহানপুর রেলগেট এলাকায় অর্ধশতাধিক কিশোর অপরাধীর দৌরাত্ম্য রয়েছে।

গ্যাংস্টারদের ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ড : চলতি বছরের শুরুর দিকে বন্ধুস্থানীয়দের হাতে পরপর কয়েকজন কিশোর খুন হওয়ার পর কিশোর অপরাধ ও কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ উদ্বেগ ছড়ায় সারা দেশে। রাজধানীর উত্তরায় কিশোরদের দুই দলের বিরোধে ৬ জানুয়ারি খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর। এ ঘটনার ১২ দিনের মাথায় তেজগাঁওয়ের তেজকুনীপাড়ায় ‘কে বড়, কে ছোট’ এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয় আবদুল আজিজ। এ দুটি ঘটনার মধ্যেই ১৫ জানুয়ারি রূপনগরে কামাল হোসেন নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ২ মার্চ শেওড়াপাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কিশোর সজীব মিয়াকে। ২০ মে যাত্রাবাড়ীতে জাহিদুল হাওলাদার নামে একটি ফ্যান কারখানার কর্মী কিশোর হত্যার শিকার হয়। গত বছরের ২৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর দারুসসালামের লালকুটি এলাকায় ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে শাহিন (১৬) নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কয়েকজন কিশোর। এ ঘটনায় ডালিম নামের এক কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ডালিম একটি গ্যাংয়ের নেতৃত্বে ছিল। ২২ আগস্ট মঙ্গলবার উত্তর পীরেরবাগে কবির হোসেন (২১) নামে এক প্রিন্টিং কারখানার কর্মীকেও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে কুপিয়ে হত্যা করে কয়েক তরুণ। গত বছরের ২ জুলাই সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে রাজধানীর শেখেরটেক ৬ নম্বর সড়কে সজল নামে এক কিশোর খুন হয়। এ ঘটনায় চার আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সর্বশেষ খবর